সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

তবে কি ক্যাবলা আর ক্যাবলামির অস্তিত্ব আপেক্ষিকতায় আক্রান্ত? জাত-ক্যাবলারাও কি ক্ষেত্র বিশেষে ভারি বুদ্ধিমান হয়?
যেমন, দাশু, ওরফে দাশরথীকে দেখলে বোঝা কঠিন যে সে কী! রামগরুড়ের ছানা, হুঁকোমুখো হ্যাংলা অথবা আদ্যানাথের মেসোর খবর রাখা জগমোহন আদতে কেমন মানুষ? “এই করেছ ভালো নিঠুর হে” বলাটা কি নেহাত ক্যাবলামি? ā”বহু বাসনায় প্রাণপণে” চাওয়ায় নাকি “বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে”র মনোবাসনাতেই ক্যাবলামিগুলো অসাধারণ হয়ে ওঠে? “আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই তখন যাহা পাই” তাকে বারে বারে হারানোতেই ক্যাবলামির উদযাপন নাকি “নাই, নাই নাই গো” বলে “সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন” বাজাতেই তার সার্থকতা? কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনোবেদনা, নিশ্চেতন হাহাকার, অনিশ্চয় আকাঙ্ক্ষা, সার্বিক আত্মসমর্পণ, সুদূরের পিপাসা নাকি অনন্ত শূন্যবাদ… ক্যাবলাদের মনের পাসওয়ার্ড ঠিক কীসে মেলে? আদৌ কি মেলে?
ছোটবেলার বড় বড় বিস্ময় আর বড়বেলার ছোট ছোট ক্যাবলামির আকাশে নবজলদঘনশ্যাম মেঘের মতো ঝুলে থাকে এইসব বাঁধন-নাশা চিরকালের হাসি কান্নার দল… বৃষ্টি হয়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে ঝরে পড়ে যখন সেসব, আকাশের গায়ে টকটক গন্ধ কি না এজাতীয় সংশয় তখন আর টেকে না, রামগরুড়ের ছানার দল তখন সোল্লাসে নেচে ওঠে বুঝি “তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি”!!

“একটা ফুটো শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে…”
কি বলল টেনিদা? আকাশের গায়ে স্বাদ নিয়ে কিছু? না, তার চেয়েও গুরুতর কিছু বুঝি। বলল বুঝি—
“কাগের ছায়া বগের ছায়া দেখছি কত ঘেঁটে/ হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে?”
তবে সে এখন থাক। বরং প্যালা কি বলছে দেখা যাক।
“যাচ্ছেতাই টক। খাওয়া যায় নাকি?
টক? টেনিদা ধুপ করে আমার পাশে বসে পড়ে বললে, টক বলে বুঝি গেরাহ্যি হল না? সংসারে টক যদি না থাকত, তাহলে আচার পেতিস কোথায়? টক যদি না থাকত তাহলে কী করে দই জমত? টক যদি না থাকত তাহলে চালকুমড়োর সঙ্গে কামরাঙার তফাত কী থাকত? টক যদি না থাকত তাহলে পিঁপড়েরা কী করে টক-টক হত? টক না থাকলে—
টক না থাকলে পৃথিবীতে আরও অনেক অঘটন ঘটত–কিন্তু সে-সবের লম্বা লিস্টি শোনবার মতো উৎসাহ আমার ছিল না। আমি বাধা দিয়ে বললুম, তাই বলে অত টক আম কোনও ভদ্দরলোকে খেতে পারে নাকি?”
অবশ্য, এসব ঝাল-মিষ্টি-টকের স্বাদে-রসে আটকে থাকা যায় না, বরং Talk গুলো জমে ওঠে, দই-এর মতো।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৫: একটাই ডেনজার জুজু যদি ধরে

রিভিউ: হোচি পারবে কুমুদিনী ভবনের রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে?

“বাধা দিয়ে টেনিদা বললে, তুই থাম না–কুরুবক কোথাকার। একটা কথা বলতে গেলেই বকবকানি শুরু করে দিবি। একাদশী পিসে ওসব হুডরু-জোনা-নেতার হাট কিছু দেখতে যাননি। তিনি গিয়েছেন কাঁকেতে।
কাঁকে?–আমি চমকে বললুম, সেখানে তো…
আমার পিঠে প্রকাণ্ড একটা থাবড়া বসিয়ে টেনিদা বললে, ইয়াহ–এতক্ষণে বুঝেছিস। সেখানে পাগলাগারদ। তোর নিজের জায়গা কিনা, তাই কাঁকে বলবার সঙ্গে সঙ্গেই খুশি হয়ে উঠলি!”
একাদশী পিসে উকিল। তাঁর টাকা পয়সা অগাধ। তেমনই অগাধ তাঁর কৃপণতা।
“—তা ছাড়া আর কী! সামনা-সামনি কিছু বললেন না, কিন্তু চমৎকার প্ল্যান আঁটলেন একটা। পিসে তো কড়াইয়ের দাল, চচ্চড়ি আর তাঁর সেই মাছ খেয়ে নিয়মিত কোর্টে চলে যান। আর পিসিমা কী করেন? তক্ষুনি চাকরকে বাজারে পাঠান-গলদা চিংড়ি, ইলিশ, মাছ, পাকা পোনা, ভাল মাংস, ডিম এইসব আনান। সেগুলো তখন রান্না হয়, পিসিমা খান, ঝি-চাকর খায়–বাড়িতে যে-দুটো মড়াখেকো বেড়াল ছিল তারা দেখতে-দেখতে তেল-তাগড়া হয়ে যায়।”
তারপর একদিন পিসেমশাই কোর্ট থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসব দেখে ভির্মি খেলেন। আঁতকে উঠে এসবের উত্স জানতে চাইলে পিসিমা সুন্দর করে বানানো এক শিবের গীত শোনালেন। কোথাকার কোন মক্কেল মামলা জিতে এসব দিয়ে গিয়েছে। এখন খেলেই হল। কিন্তু তেল ঘি মশলাপাতি? তাও দিয়েছে কি? দিয়েছে তো বটেই।
“অগত্যা পিসে বসে গেলেন। কিন্তু ডাল থেকে মুড়ো তুলে মুখে দিয়েই হঠাৎ একটা আর্তনাদ করলেন তিনি।
এ যে যজ্ঞির রামা।
পিসিমা বললেন, পরের পয়সায় তো।
কিন্তু কয়লা পুড়ল যে।
পিসিমা বললেন, কয়লা তো পোড়াইনি। চাকর দিয়ে শুকনো ডাল-পালা কুড়িয়ে আনিয়েছি।
কিন্তু, কিন্তু-হাঁড়ি-ডেকচিগুলো?—
বুকফাটা চিৎকার করলেন পিসেমশাই।
সেগুলো আগুনে পুড়ল না এতক্ষণ? ক্ষতি হল না তাতে? তারপর মাজতে হবে না? আরও ক্ষয়ে যাবে না সেজন্যে?–বলতে বলতে পিসেমশাই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন: গেল—আমার এত টাকার হাঁড়ি-ডেকচি ক্ষয়ে গেল আর কাঁদতে কাঁদতে ঠাস করে পড়ে গেলেন। পড়েই অজ্ঞান।”
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

ওই যে, কবি বলেছিলেন, “দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য ক’রে অতি-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে/ আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।”
পিসে যতদিন রাঁচি থাকবেন, ততদিন যদি পিসির বাড়ি ঘুরে আসা যায়? টেনিদার ইচ্ছা তেমনই, পেটরোগা প্যালাও একপায়ে খাড়া।
আমরা বরং একটু অন্যত্র যাই।
“নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা একদিন তাকে বললে, চলো, আজ রাত্রে আমরা তোমার বাড়িতে খাব।
বেশ, এসো আমার সঙ্গে, বললে নাসিরুদ্দিন।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে বললে, তোমরা একটু সবুর করো, আমি আগে গিন্নিকে বলে আসি ব্যবস্থা করতে।
গিন্নি তো ব্যাপার শুনে এই মারে তো সেই মারে। বললেন, চালাকি পেয়েছ? এত লোকের রান্না কি চাট্টিখানি কথা? যাও, বলে এসো ওসব হবে-টবে না।”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

“ক্যাবলা” নাসিরুদ্দিন তখন গিন্নির পরামর্শে দোতলায় গিয়ে বসে রইল। বন্ধুরা শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লে মিসেস নাসিরুদ্দিন তাদের অবাক করে দিয়ে জানান “ও বেরিয়ে গেছে”… কী করে বেরোয়? দরজা আগলে তো বন্ধুর দল, বেরোয় কোন পথে হে?
“নাসিরুদ্দিন দোতলার ঘর থেকে সব শুনে আর থাকতে না পেরে বললে, তোমরা তো সদর দরজায় চোখ রেখেছ; সে বুঝি খিড়কি দিয়ে বেরোতে পারে না?”
শেক্সপিয়ার একবার এমন একটা কথাই বলেছিলেন বুঝি! হে হোরেশিও! তোমার জানার বাইরেও একটা জগত্ আছে, খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের ছাব্বিশ ইঞ্চি মাপের বাইরের সেই দুনিয়াটায় সদর-খিড়কির চেনাজানা গতিবিধিগুলোও অন্যরকম ঠেকে খানিক। মাপে বাঁধা খাপে পোরা জীবনে যা ক্যাবলামি আর হাস্যকর, যা করলে নিশ্চিত ঠিকানা রাঁচি কিংবা করাচি, ক্যাবলামির আশ্চর্য দুনিয়ার দুনিয়াদারিতে তা-ই নির্মোহ, নিরুদ্বেগ আত্মকথন হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে সকল কিছুই সত্য-স্বাভাবিক, কিছুই প্রশ্নাতীত নয়, কিছুই বুঝি গড্ডলিকার পিছনে ধাবমান জগতের মতো নয়, সকল সংকল্প, প্রকল্প সেখানে শিব আর সুন্দরের ছোঁয়ায় প্রদীপ্ত… সেই জগতে বসে দাশুর বাক্স একটার পর একটা খুলতে থাকে, টান টান উত্তেজনার পারদ বাড়ে, শেষ পর্যন্ত কাঁচকলা কিংবা “কাগের বাসায় বগের ডিম”টাই হয়তো বা পাওয়া যায়। তবুও শেষ হয় কি?
যারা মহাপণ্ডিত, নিয়মিত সমুদ্রে গামলা ভাসান আর তাতে ছিদ্র দেখা দিলেই জাগতিক ক্যাবলামিতে বড়োই বিরক্ত হয়ে বলেন…
“বলছি ওরে, ছাগল ছানা, উড়িস নে রে উড়িস নে/ জানিস তোদের উড়তে মানা– হাতপাগুলো ছুড়িস নে।”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

এর উত্তরে সেই তথাকথিত ছায়াযুদ্ধের যোদ্ধা “ক্যাবলারা” কী করে?
“দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, “ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?” এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, “আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।” দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।”
নাসিরুদ্দিন এসব শুনলে কি বলতেন?
“সুসংবাদ দিলে বকশিশ পায় জেনে একজন লোক নাসিরুদ্দিনকে গিয়ে বললে, তোমার জন্য খুব ভাল খবর আছে, মোল্লাসাহেব।
কী খবর?
তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
তাতে আমার কী?
তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।
তাতে তোমার কী?”
চোরাবালি কতখানি গিলেছে আমাদের রোজ, তা জেনেও, খানিক মেনেও বা, ঠোঁটে ফুটে ওঠা বেঁচে থাকার আর বাঁচিয়ে রাখার গানগুলোই না হয় বেঁচে থাকুক রোজ!

ঋণ স্বীকার:
শিরোনাম কবি মৃদুল দাশগুপ্তের “জলপাইকাঠের এসরাজ” কাব্যগ্রন্থ থেকে
পেশোয়ার কী আমীর, একাদশীর রাঁচিযাত্রা, চামচিকে আর টিকিট চেকার : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
ছায়াবাজি, আবোল তাবোল, চীনেপটকা: সুকুমার রায়
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প: সত্যজিৎ রায়
বেঁচে থাকার গান: অনুপম রায়
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content