রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস রাষ্ট্রের বিচারে নিজ হাতে হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই ঘটনা প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরানো হলেও আজও লোকমুখে এটি বহুল চর্চিত। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরাও স্বেচ্ছায় বিষ পান করে চলেছি প্রতিনিয়ত। এগুলি সাদা বিষ নামেই বেশি পরিচিত। আমাদের জীবনযাত্রায় ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই সাদা বিষগুলি। কোনও একটি নয়, সাদা বিষ হল—রিফাইন্ড চিনি, সাদা ময়দা, পালিশ করা চাল, রিফাইন্ড লবণ এবং পাস্তুরাইজড দুধ ইত্যাদি।

পুষ্টিবিদদের একাংশের মত, চিনির মধ্যে কোনও পুষ্টি গুণ নেই, এর শক্তি ‘শূন্য শক্তি’ নামে পরিচিত। চিনি গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ নিয়ে গঠিত। হায়দারবাদে অবস্থিত জাতীয় পুষ্টি সংস্থার বক্তব্য, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সারা দিনে খাবারের সঙ্গে এবং অন্যান্য ভাবে মোট ২০-২৫ গ্রাম চিনি গ্রহণ করতে পারেন। তার অধিক চিনি গ্রহণ করলে টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা, স্থূলতা, দাঁতের ক্ষয়, রক্তে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বৃদ্ধি ও ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যা তো আছেই।
আধুনিক জীবনযাত্রায় আমরা প্রতিনিয়ত আটার পরিবর্তে ময়দা ব্যবহার করছি। ফলে খাদ্য হিসাবে আমরা কেবল শ্বেতসারটুকুই গ্রহণ করে থাকি। বর্তমানে আমরা অধিক পরিমাণে ময়দা ও ময়দাজাতীয় খাদ্য যথা রুটি, লুচি, পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, নুডুলস ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছি। এ সবের জন্য আমরা গমের বহিস্তক ও এন্ডোস্পার্ম বাদ দিয়ে দিচ্ছি। ফলে আমরা কেবল শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যই গ্রহণ করছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন খোসা বা রাফেজও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।

পশ্চিমী দেশের মানুষ খাদ্য হিসাবে কেবলমাত্র রুটি, মাংস বা বার্গার জাতীয় খাবার গ্রহণ করে। ফলে তাদের খাবারে কোনও তন্তুজাতীয় পদার্থ থাকে না। এর জেরে তাদের পায়ু ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। আমেরিকার এফডিএ-এর মতে, আমরা সারাদিনে যে খাদ্য গ্রহণ করে থাকি, তার অন্ততপক্ষে ৫০ শতাংশ গোটা দানাশস্য বা তার গুড়ো থাকার প্রয়োজন। তবে কারও কারও বক্তব্য, ময়দা বা আটায় যে গ্লুটেন থাকে তা অনেক ক্ষেত্রেই সহজে হজম হতে চায় না। ফলস্বরূপ গ্যাস, অম্বল এবং বদহজমের সমস্যা হতে পারে।
আরও পড়ুন:

শিলাইদহে ‘নতুন বাবুমশাই’-এর কড়া নির্দেশ, এই নিয়মের বদল না হলে আজ পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হবেই না

অজানার সন্ধানে: এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?

পালিশ করা চালের ক্ষেত্রেও তার বাইরে যে আবরণ তা পালিশ করে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে পড়ে থাকে কেবল এন্ডোস্পার্ম, যা শ্বেতসার ব্যতীত কিছুই নয়। এই ধরনের চাল থেকে তৈরি ভাত আমাদের রক্তে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বৃদ্ধি করে, যা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকারক।

রিফাইন্ড লবণ হল অতি পরিশুদ্ধ লবণ। এতে কিছু ক্ষেত্রে আয়োডিনকে বাদ দিয়ে ফ্লুরাইডকে প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। আমাদের শরীরে আয়োডিনযুক্ত লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তা আমাদের শরীরে একসঙ্গে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়োডিন এর চাহিদা মেটায়। কিন্তু আয়োডিনের পরিবর্তে ফ্লুরাইডের ব্যবহার, শরীরে এর বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রোজ দিন ১৫০০ থেকে ৩৪০০ মিগ্রা সোডিয়াম অর্থাৎ মাত্র ৫ গ্রাম বা এক চামচ লবণ খাওয়া উচিত। তাই অধিক লবণ যুক্ত খাদ্য, সোডিয়াম বেনজোয়েট ও মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ইত্যাদি যুক্ত খাবার বর্জন করাই শ্রেয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা

পর্দার আড়ালে: পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে

বিভিন্ন ফাস্টফুডের মধ্যে স্বাদবৃদ্ধিকারক হিসেবে যে আজিনোমোটো যুক্ত করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট ছাড়া আর কিছুই নয়। এটিই আমাদের শরীরের নানান সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমন মাথায় যন্ত্রণা, বমিবমি ভাব, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ও বুকে যন্ত্রণা ইত্যাদি। প্যাকেটজাত পাস্তুরাইজড দুধ একপ্রকার সাদা বিষ। কারণ এই পাস্তুরাইজেশনের সময় দুধের মধ্যে ভালো এবং মন্দ উভয় প্রকার ব্যাকটেরিয়াই নষ্ট হয়ে থাকে।

দুধের একটি অতি প্রয়োজনীয় উৎসেচক হল ফস্ফাটেজ, যা নষ্ট হয়। এই ফস্ফাটেজ আমাদের শরীরে ক্যালশিয়াম শোষণে সাহায্য করে থাকে। এই ক্যালশিয়াম আবার পরবর্তীকালে আমাদের অস্থি এবং দাঁতের গঠনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। এছাড়াও এই প্রকার দুধের মধ্যে ভিটামিন-এ, বি-১২ এবং সি নষ্ট হয়ে যায়। এই দুধে শর্করা, কিছু প্রোটিন ও জল ইত্যাদি ব্যতীত আমরা প্রায় কিছুই পাই না। এই সকল খাদ্য অর্থাৎ সাদা বিষ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

এ সবের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও মানসিক দুশ্চিন্তা বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসকে ডেকে আনছে। এই সব কারণে সারা বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও ব্যাপকভাবে ডায়াবেটিস বা মধুমেয় রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০০৬ সালে যেখানে ভারতে ডায়াবেটিস রোগী ছিল প্রায় ৪ কোটি, সেখানে ২০১৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় প্রায় ৭ কোটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সালে এই সংখ্যাটি দাঁড়াবে প্রায় ৮ কোটিতে।

সুতরাং পরিস্থিতি বদলাতে হলে আমাদের সৌখিনতাকে দূরে সরিয়ে সাদামাটা জীবনযাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে সাদামাটা অথচ বিজ্ঞানসম্মত খাদ্য গ্রহণ করা জরুরি। তবেই আমরা বিভিন্ন রোগবালাই থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারব।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content