শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


১৯৬০ সালে হলিউডে যখন হিচককের ‘সাইকো’ মুক্তি পায়, সৃষ্টি হয় এক নতুন ক্রাইম জ্ঁয়ের-স্ল্যাশার। অতলান্তিক মহাসাগরের অন্য পারে সেই বছরই মুক্তি পায় হিচকক ও হলিউডের অনুরাগী এক নবীন ফরাসী চিত্রপরিচালকদের দলের এক অন্যতম সদস্য, জাঁ লুক গোদারের ‘এ বাউট ডি সুফ্লে’। সেই ছবি জন্ম দেয় এক নতুন ধাঁচের ক্রাইম নোয়ার যা, এখনও বহু ‘গ্যাংস্টার-ইন-লাভ’ ছবির স্বপ্ন। ইংরাজিতে এই ছবি ‘ব্রেথলেস’ নামে পরিচিত। যদিও ডেভিড স্টেরিট জানান ফরাসি নাম ‘এ বাউট ডি সুফ্লে’-এর অর্থ ইংরাজি শব্দ ব্রেথলেসের থেকে খানিকটা আলাদা। ফরাসি নামটির বাংলা অনুবাদ ‘ক্লান্তির শেষ পর্যায়’ বা ‘ক্লান্তিতে নিশ্বাসের শেষ সীমানা’ করলে খানিকটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। ছবিটিও তার নামেরই মতো দ্ব্যর্থক ও তরল। ভয়, প্রেম, মৃত্যু, মিথ্যে, বন্দুক, নোয়া, পিকাসো, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, শঁসেলিজে মিলিয়ে বানানো গদারের সবথেকে জনপ্রিয় নিউ ওয়েভ ক্লাসিক—’এ বাউট ডি সুফ্লে’।

নায়ক মিচেল পিকার্ড (জাঁ পল বেলমন্ডো) প্যারিসবাসী। স্প্যানিশ ‘পিকারো’-দের মতো তাঁর গতিবিধি। গাড়ি চুরি, অসংখ্য মহিলাদের সঙ্গে যৌনতা, চুরি ছিনতাই, প্যারিসের অলিগলি ঘোরা এই তার নিত্যদিনের জীবন। অল্প কথায় দায়িত্বজ্ঞানহীন লম্পট প্যারিসবাসী, যে জীবনে শুধু গতি খোঁজে। ছবির শুরুতে সে চুরি করা গাড়ি চালাতে চালাতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকের সঙ্গে কথা বলে। মানে গোদার প্রথমেই সচেতনভাবে চলচ্চিত্রের চিরায়ত প্রথা যা ক্যামেরার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা শেখায় তাকে ভেঙে ফেলেন। গোদারের মতো এই অনায়াসে নিয়ম ভাঙার নির্লিপ্ততায় অভ্যস্ত মিচেল একদিন বন্দুক তাক করে তাকে ধরতে আসা পুলিশের দিকে। ‘ডোন্ট মুভ ওর আই উইল শুট’। আপাত দৃষ্টিতে গতানুগতিক আবেগ প্রধান যে কোনও হলিউড ছবির সংলাপ। মিচেলের পছন্দও অতিনাটকীয়তা।
তবে তারপর যা ঘটে তা গতানুগতিক নয়। ক্যামেরা আস্তে আস্তে নামে মিচেলের হাতের এক্সট্রিম ক্লোজ শট নিয়ে। মিচেলের কব্জির মোটা চেন বেয়ে, রিভলভারের ধীর গতিতে ঘুরে চলা চেম্বার ছুঁয়ে, ক্যামেরা এগোয় সেই রিভলভরের নলের দিকে। বহু যত্নে, বহু লালনে তোলা শট। তার পরের শটে রিভলভরের আওয়াজ ও পুলিশের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়া একইসঙ্গে ঘটে। হঠাৎ জাম্প কাটের সাহায্যে দর্শককে দূরে ঠেলে দেয় গোদার। দর্শক লং শটে ওভারহেড ভিউয়ে পায় মিচেলের দৌড়ে পালানোর দৃশ্য। অর্থাৎ ক্লোজ শটের মধ্যে দিয়ে মিচেলের সঙ্গে একাত্মবোধ করার রোমাঞ্চের সম্ভাবনা গোদার দর্শকের মন থেকে হেলায় মুছে ফেলেন। ক্লোজ শটে দেখানো মিচেলের হাত, কব্জি ও তার রিভলভার এবং ঠিক তারপরই জাম্প কাটের মাধ্যমে নায়ককে দূরে সরিয়ে দিয়ে গোদার নির্মাণ করেন তার স্বকীয় ‘এলিয়ানেশন এফেক্ট’। মূল চরিত্রের সঙ্গে অভিন্নতার আরাম নয়, বিচ্ছিন্নতার অস্বস্তি সৃষ্টি করায় বেশি আগ্রহী গোদার।

প্রেমিকার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করা, টুকটাক লুঠ ছিনতাই, কোনও এক পরিচিতের থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ওত পেতে থাকা, পুলিশের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করা ও তার সদ্য হওয়া প্রেমিকা প্যাট্রিশিয়ার (জঁ সিবার্গ) সঙ্গে শঁসেলিজের এপার থেকে ওপার হাঁটা বা সাদা চাদরের উপর দু’ জনের শুয়ে থাকা। এই ভাবেই কাটে মিচেলের সময়। প্যাট্রিশিয়া রূপসী প্রাণবন্ত এক আমেরিকান। ফ্রান্সে আসার কারণ সাবর্ণ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা ও পরে নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রাইবিউনে চাকরি করা। এই দুই প্রেমিক প্রেমিকাকে আমরা ক্যামেরার স্লো ট্র্যাকে অনুসরণ করি। শঁসেলিজে-তে। কথা চলে, হাঁটা চলে, মিচেলের প্রেম নিবেদনও চলে। মনে হয় এই তো প্রাণোচ্ছ্বল সুন্দর ঝকঝকে প্যারিস। প্রেমের শহর প্যারিস।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৬: হিচককের সাইকো—ম্যারিয়নের স্নান ও নর্মা-র মৃতদেহ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

ক্লাসরুম: উচ্চ মাধ্যমিকে দশের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না, তবে মন বলছিল—আমি পারব

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

পুলিশ খুন, চুরি, মিথ্যাচারের উপর প্রেমের প্রলেপ পড়ে। নায়ক রাতে নায়িকার সঙ্গে দেখা করার আশ্বাস দিয়ে সরে যায় ক্যামেরার ফ্রেম থেকে। তারপর আবার জাম্প কাট। তেরছা ওভারহেড লং শটে আবার ছিটকে যাই দূরে। নায়িকা তখন রাস্তা পার করে চুমু খায় নায়ককে। আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি আবার। ক্যামেরার দূরে সরে যাওয়া ও সাউন্ড ট্র্যাকে হঠাৎ ব্রাস কর্ডের ঝঙ্কার আপাত শান্ত দৃশ্যে আনে অস্থিরতা। এক অশনি সংকেত। ক্লোজ শটে ফিরে আসা ক্যামেরা দেখায় রাস্তার পোস্টার ‘লিভ ডেঞ্জারেসলি টিল দ্য এন্ড’ আর তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া মিচেল। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে সেই অশান্ত ব্রাস কর্ড।

মিচেল আর প্যাট্রিশিয়ার পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া, তাদের একসঙ্গে থাকা, পুলিশের প্যাট্রিশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা, প্যাট্রিশিয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া এবং শেষে পুলিশের কাছে খানিকটা ক্লান্ত হয়েই প্যাট্রিশিয়ার মিচেল সম্বন্ধে তথ্য দেওয়া। ছবির ঘটনাবহুল পটভূমি, নায়ক নায়িকার নিত্যদিনের পালিয়ে বেড়ানোর গতি কাহিল করে দর্শককেও। শেষে মিচেল যখন জানতে পারে প্যাট্রিশিয়া তার কথা জানিয়েছে এক ডিটেকটিভকে, সে বলে ‘আই অ্যাম বিট এনিওয়ে। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু স্লিপ’। হয়তো সেই সময় কিছুটা একাত্মবোধ করি আমরা এই তীব্র গতিতে বিশ্বাসী ক্লান্ত নায়কের সঙ্গে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৬: মজল আঁখি মজেছে মন, ইমোজি তোদের ডাকল যখন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৪: রাজনীতিতে নিজের উন্নতি করতে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতির মতো মানুষের উপরেও বিশ্বাস করা অনুচিত

মিচেলের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে। রাস্তার মাঝে। অসংলগ্নতা ও বিচ্ছিন্নতা মিচেলের ও এই ছবির মূলে। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথাও আপাতদৃষ্টিতে অসংলগ্ন। তার শেষ বাক্য ভাষার প্রতিবন্ধকতার, ভাষার সীমিত ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়— ‘সে ভ্রেমন্ত দেগাইলাস’, যা ইংরাজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ইট ইজ রিয়েলি ডিসগাস্টিং’। স্টেরিট ‘দ্য ফিল্মস অফ জাঁ লুক গোদার’-এ জানান, আমেরিকান প্যাট্রিশিয়া ও ইংরাজিভাষী দর্শক, এই দুয়ের কাছেই শব্দগুলোর মানে অস্পষ্ট। ইংরাজি সাবটাইটেল দেখায়—’ইউ আর … রিয়েলি…’।

একজন পথচারী প্যাট্রিশিয়াকে এর মানে বোঝায় ‘ইউ আর রিয়েলি এ বিচ’। অর্থাৎ মিচেলের শেষ উপলব্ধি যা হয়তো ছিল “এই চারপাশ, এই শহর যেখানে আমরা দু’ জনই আটকে পড়ে ছিলাম—সবই কষাটে, সবই বিতৃষ্ণাজনক”। অনুবাদিত হয় “তুমি কষাটে। তুমি বিরক্তিকর’-এ। ভাষার তুচ্ছতায় হারিয়ে যায় ‘স্টার ক্রসড’ যুগলের ট্র্যাজেডি। জাঁ পল সাঁত্রের ‘নজিয়া’-র বিবমিষা বা কনরাডের ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-এর ‘দ্য হরর! দ্য হরর!’-এর ক্লেদক্লিষ্ট জীবনের কথা বলে যায় মিচেল। মিচেল মারা যায়, প্যাট্রিশিয়া মুখ ফিরিয়ে নেয় ক্যামেরার থেকে, দর্শকের থেকে। আশপাশের স্থবিরতা নস্যাৎ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অস্তিত্ববাদী দর্শন ও বিট জেনারেশনের অস্থিরতা “ব্রেথলেস”-এর জাঁকানো রসদ হিসেবে থেকে যায়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৩: গোবিন্দর হেঁয়ালি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট

‘ব্রেথলেস’ যখন তৈরি হচ্ছে ফরাসি সমাজ তখন যথেষ্ট অস্থির। অ্যালজেরিয়ান মুক্তি যুদ্ধ তুঙ্গে। শার্ল দ্য গল ফ্রান্সের সবথেকে পুরোনো উপনিবেশ রক্ষার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ফরাসি সিনেমার জগতে মুক্তি পেয়েছে অ্যালে রেঁনের ‘হিরোশিমা মন আমোর’ (১৯৫৯), ও ফ্রানসোয়াঁ ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ (১৯৫৯)। ফরাসি নবতরঙ্গ উপচে পড়ছে বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে। আন্দ্রে বাজার হাত ধরে ‘কাইয়ে দু সিনেমা’-র পাতায় তৈরি হচ্ছে ফরাসি চলচ্চিত্র শৈলীর এক নতুন পথ। ত্রুফো, গোদার, এরিক রোমার, জাক্স রিভেট, ক্লড শব্রল, রেঁনে, অ্যাগনেস ভার্দা সিনেমায় আনছেন এক যুগান্তকারি দিক যা মূলধারার চলচ্চিত্র ঐতিহ্যের ধার ধারে না। এঁদের উদ্ভাবনী সম্পাদনাশৈলী, লং টেক, অনিয়মিত, খণ্ডিত আখ্যান ছবিতে আনে ডকুমেন্টারির স্বাদ।

চলচ্চিত্র ও জীবন মিশে যায় বাস্তব ও কল্পনার এক অদ্ভুত সমন্বয়ে। সৃষ্টি হয় রেঁনের ‘হিরোশিমা মন আমোর’ (১৯৫৯), গোদারের ‘এ বাউট ডি সুফ্লে’ (১৯৬০), শেব্রলের ‘ল্য বন ফেম’ (১৯৬০), ত্রুফোর ‘শুট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার’ (১৯৬০), ডেমির ‘লোলা’ (১৯৬১), ভার্দার ‘ক্লিও ফ্রম ফাইভ টু সেভেন’ (১৯৬২) ও আরও বহু সাহসী ছবি যা এখনও সিনেফাইলদের মুগ্ধ করে চলেছে। —চলবে।
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content