শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

পঞ্চম নিজেও হয়তো বুঝতে পারেননি যে, তাঁর কাছে এ বার বড় কোনও সুযোগ আসতে চলেছে। যে সুযোগ তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই কালজয়ী সুরকারের তকমা এনে দিতে পারে। যে সুযোগ তাঁর এতদিনের অর্জন করা যশ এবং খ্যাতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে কয়েকগুণ। কোন সুযোগের কথা বলছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন। আমি রমেশ সিপ্পি পরিচালিত ‘শোলে’ ছবিটির কথাই বলছি।

বলিউডের ইতিহাসে এরকম ছবির দ্বিতীয় কোনও দৃষ্টান্ত এক কথায় বিরল। সেই যুগে তো বটেই, হয়তো আজকের যুগেও। ছবির গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, নির্দেশনা, অভিনেতা অভিনেত্রীদের নির্ভুল অভিনয়, শুটিংয়ের ক্ষেত্রে তৎকালীন উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, গান এবং গানের সুর সব মিলিয়ে বলতে গেলে—একশোতে একশো। নম্বর কেটে নেওয়ার কোনও অবকাশই নেই। স্পট সিলেকশন, ক্যামেরার কারিকুরি, এডিটিং, ডাবিং কোনও কিছুতেই লাল কালি দেওয়ার জায়গা নেই।

এ হেন ছবিতে পঞ্চমের ডাক পড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক! সেটাই হল। গান লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় আনন্দ বক্সীকে। যথারীতি ডাক পান পঞ্চম। ছবির গল্প এবং চিত্রনাট্য পড়ার পর তিনি বেশ বুঝতে পারেন যে, এই ছবিটি আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব হতে চলেছে। বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে শুরু করে দেন সুর রচনার কর্মকাণ্ড। প্রতিটি দৃশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝে নেন নির্দেশকের কাছ থেকে। শুরু থেকে শেষ অবধি। আনন্দ বক্সীর কাছ থেকে নিয়ে নেন ছবির প্রতিটি গান। নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়ে থাকেন সেই গানগুলিতে সুর বসানোর কাজে। শুধু তাই নয়, ছবির প্রতিটি দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়েও চলতে থাকে সুগভীর গবেষণা।
এ যেন এক মহাযজ্ঞ। তৈরি হয় টাইটেল মিউজিক। নতুন ভারপ্রাপ্ত জেলার সাহেবের ট্রেন স্টেশনে এসে থামে। ট্রেন থেকে নেমে তিনি ওঠেন একটি ঘোড়ার পিঠে। মারেন চাবুক। ছুটতে শুরু করে ঘোড়া। আর সেই সঙ্গে ভানু গুপ্তর অ্যাকোস্টিক গিটার দিয়ে যে রিদম শুরু হয় তা আমরা আজও কি কেউ ভুলতে পেরেছি? তারপরেই বেজে ওঠে বঙ্গ। মূল ছন্দটিকে এগিয়ে নিয়ে চলে ছুটন্ত ঘোড়ার তালে তালে। বঙ্গ, তবলা, মাদল, বাঁশি, ট্রাম্পেট, ভায়োলিন, ড্রাম, পারকাশনের সঙ্গে ঘোড়ার খুরের শব্দ। সব যেন মিলেমিশে একাকার।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ঘোড়া যখন পাহাড়ঘেরা অঞ্চলগুলি দিয়ে ছুটছে তখন সুর এবং ছন্দের ধাঁচটি একরকম। কিন্তু সেই ঘোড়াই যখন লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে, তখন সুরের কাঠামো কিন্তু একটু আলাদা। এ সবই পঞ্চমকে সবার থেকে একটু হলেও আলাদা করে রাখে।

এছাড়াও সন্ধেবেলার একটি দৃশ্যে যখন জয় (অমিতাভ বচ্চন) এক বিধবা নারীকে (জয়া বচ্চন) প্রেম নিবেদন করছেন একটি হার্মনিকার মাধ্যমে, বারান্দায় জ্বলে থাকা লণ্ঠনগুলির আলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। কী অসাধারণ এক অনুভূতির সঞ্চার হয় বলুন তো। পঞ্চম যেন নিজেকে অমিতাভের জায়গায় বসিয়ে ওই মেলোডির জন্ম দিয়েছিলেন। ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে যখন ডাকাত সর্দার গব্বর সিং (আমজাদ খান) আবির্ভূত হচ্ছেন, তখন আমরা শিউরে উঠেছি সেই হাড়হিম করা শব্দে।

জানেন কি, সেই শব্দের উৎপত্তি কিসের থেকে নেওয়া? পঞ্চম সেটির জন্ম দিয়েছেন অ্যাম্বাসেডর গাড়ির ‘ডিফারেনশিয়াল’ নামক একটি যন্ত্রাংশ থেকে। সেটিকে দেখতে একটি গোল চাকতির মতো। তার চারপাশ থেকে মাঝারি মাপের লোহার রড বেরিয়ে এসেছে। সেই রডগুলির ওপর ড্রামস্টিক দিয়ে আস্তে আস্তে আঘাত করলে ওই রকম শব্দের জন্ম হয়। ভাবা যায়!
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

বাসন্তী (হেমা মালিনী) যখন একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছেন, দৃশ্যের উত্তেজনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পণ্ডিত সমতা প্রাসাদের তবলার যাদু। বাদ্যযন্ত্রের প্রাচুর্য এই দৃশ্যে একদমই কানে আসে না। কিন্তু দ্রুত গতির ওই তবলা একটি টানটান উত্তেজনায় মাতিয়ে রাখে দর্শকবৃন্দকে।

‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তরেঙ্গে’ গানটি সেই যুগে তো বটেই, আজকের তারিখেও অনন্য। কিশোর কুমার এবং মান্না দে নিজেদের সবটুকু দিয়ে গানটি উপস্থাপিত করেছেন। গানটির আবেদন এতটাই যে আজকের দিনেও গানটির বিভিন্ন ধরনের ‘রিমেক ভার্সন’ আমাদের কানে আসে। তাই হয়তো পঞ্চম কালের উর্ধ্বে।

ডেমিস রৌসসের ‘সে ইউ লাভ মি’ গানটি একবার নাকি সিপ্পি দম্পতি লন্ডনে কোনও এক অনুষ্ঠানে শুনেছিলেন। আর তাই পঞ্চমকে রমেশ সিপ্পি অনুরোধ করেন ওই গানটির অনুকরণে একটি সুর তৈরি করে ‘শোলে’র একটি দৃশ্যে দেশজ কায়দায় ব্যবহার করতে। সেই মতো আনন্দ বক্সীকে তিনি বলেন একটি গান লিখতে। বক্সী লিখে ফেলেন ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি। এবং ‘সে ইউ লাভ মি’র অনুকরণে গানের মুখরাটি পঞ্চম বানিয়ে ফেলেন ঠিকই। কিন্তু অন্তরাটি সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজের সৃষ্টি।

কি অদ্ভুত ভাবে মিলিয়েছেন মুখরা এবং অন্তরা। গান তো তৈরি হল। এর পর যেটুকু জানা যায়, অনেক আশা নিয়ে পঞ্চম গেলেন আশা ভোঁসলের কাছে। গানটি তাঁকে শোনালেন। শুনিয়ে বললেন যে, গানটি আশাকেই গাইতে হবে। কিন্তু সেই কাজটি করতে হবে কণ্ঠ কিছুটা পরিবর্তন করে। অর্থাৎ তিনি যেন পুরো গানটি বেস এ গান।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

কিন্তু আশা কিছুটা চটেই গেলেন এই প্রস্তাব শুনে। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, নিজের কণ্ঠকে বিকৃত করে গোটা একটি গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না। বেচারা পঞ্চম। আর কোনও উপায় না খুজে পেয়ে নিজেই কাঁধে তুলে নিলেন গানটি গাওয়ার গুরুদায়িত্ব। সেই মতো রেকর্ডিং শেষ হল। শুনলে অবাক হবেন, এই গানটিকে ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই দৃশ্যটি পরিচালক সিপ্পি নতুন করে তৈরি করেন। প্রাথমিক ভাবে চিত্রনাট্যে এই দৃশ্যের কোনও উল্লেখই ছিল না। সেলিম জাভেদ (সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার) জুটির তৈরি চিত্রনাট্য।
তাই সব কিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর সিপ্পির নতুন করে এই গানটির জন্য একটি দৃশ্যের অন্তর্ভুক্তি, বিশেষ করে এমন একটি গানের সংযোজনে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন জাভেদ আখতার সাহেব। কিন্তু রমেশ সিপ্পি তাঁকে অনুরোধ করেন গানটি ভালো করে একটিবার শোনার জন্য। গানটি শোনার পর জাভেদ সাহেবের মত বদলায়। রাজি হন তিনি। সেই সঙ্গে পঞ্চমের ভুয়সী প্রসংশা করেন।

তবে এমনও শোনা যায় ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানটি প্রথমে মান্না দে-র গাওয়ার কথা ছিল। তবে আরডি-র গলায় রেকর্ড হওয়ার পর মান্না দে-র সেই গান খুবই পছন্দ হয়। তখন উনি পঞ্চমকে ওটাই রাখার অনুরোধ করেন। শেষমেশ মান্না দে-র সেই অনুরোধ মেনে নেন রাহুল দেব বর্মণ।

মোটামুটি ৩ কোটি টাকার বাজেটে তৈরি ‘শোলে’র বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা না হয় নাই বা বললাম। কিন্তু সুরকার রাহুল দেব বর্মণের জন্য এই ছবি আক্ষরিক অর্থেই একটি মাইলস্টোন। তাঁর খ্যাতি, যশ, সম্মান বহুগুণ বেড়ে যায় সামগ্রিকভাবে।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: উৎসব-মুখর মথুরা: জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ব্রজভূমি দর্শন /১

বইয়ের দেশে: আট থেকে আশির সুস্থ্য থাকার হ্যান্ডবুক ‘খাবার নিয়ে ভাবনা’

গাড়ি ও বাইক: বর্ষায় প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে অফিস যান? চারচাকা নিয়ে বেরোনোর আগে এই ৫টি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখুন

তবু এতো সাফল্যের মাঝেও, কোথাও যেন ছন্দ পতন ঘটে। ১৯৭৫ সালটি পঞ্চমকে দিয়ে যায় এক চরম আঘাত। যে আঘাত তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। যে যন্ত্রণা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলেও যেন বিন্দুমাত্র উপশম হওয়ার নয়। শচীন কর্তা বেশকিছু দিন ধরে অসুস্থ থাকার পর এই বছরের ৩১ অক্টোবর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি দেন আনন্দলোকে। তিনি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন পঞ্চম শত ব্যস্ততার মধ্যেও বহুবার বাবাকে দেখতে গিয়েছেন।

অল্প কিছু কথাও হয়েছে পিতা-পুত্রের। কিন্তু পঞ্চম কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি যে তাঁর বাবা এত তাড়াতাড়ি পাড়ি দেবেন এক অজানা দেশে। যে বাবা তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু, যে বাবার হাত ধরেই তাঁর সঙ্গীত জগতে আসা। কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারেন না এই অপূরণীয় ক্ষতি। এক পলকে যেন ম্লান হয়ে যায় তাঁর এই পাহাড়প্রমাণ সাফল্য। তবু নিজেকে শক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যান মা মীরা দেব বর্মণের দিকে তাকিয়ে।

পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে পঞ্চম এক চমকপ্রদ ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন। শচীন কর্তা নার্সিংহোমে থাকাকালীন একদিন পঞ্চম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। তখন আচমকা শচীন কর্তা নাকি তাঁর বেডের পেছনে থাকা কার্ডিয়াক মনিটরিং ডিসপ্লের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে পঞ্চমকে বলেছিলেন, এটিই হল হৃদয়ের ভাষা। আর মানুষের এই হৃদয়কেই যেন তিনি ছোঁয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান নতুন নতুন সুরের মাধ্যমে।

বাবার নিষ্প্রাণ দেহের দিকে তাকিয়ে সেই দিন হয়তো সেই কথাগুলিই বার বার মনে পড়ছিল পঞ্চমের। কোথাও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সময়ে অসময়ে দেওয়া বাবার প্রতিটি উপদেশ। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অনেকেই তখন পঞ্চমে পাশে উপস্থিত ছিলেন। তবু যেন এক চরম শূন্যতা গ্রাস করে রেখেছিল তাঁকে। যে শূন্যতা পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোনও কিছু দিয়েই পূর্ণ হওয়ার নয়।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content