সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক।

বইপাড়ায় আমার প্রায়ই যাওয়া হয়ে থাকে। সেই রকম একদিন এক বইয়ের দোকানে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে হাতে এসে পড়ল ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্যের লেখা ‘খাবার নিয়ে ভাবনা’ বইটি। ডাঃ ভট্টাচার্য পেশার জগতে একজন কান নাক গলা বিশেষজ্ঞ। যুক্ত রয়েছেন বারাসত ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গেও। ডাক্তারবাবু সমান দক্ষতার সঙ্গে ৩৪ বছর ধরে লিখে চলেছেন বিভিন্ন বিষয়ের নানা ধরনের বই। এখনও পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৪। এর মধ্যে বারোটি নাটকের, তিনটি বেড়ানোর এবং পাঁচটি গল্পের বই রয়েছে। এই মুহূর্তে তিনি সিনেমা, সিরিয়াল ও নাটকের জগতে একজন পরিচিত মুখ। মানবপুত্র নাটকটির জন্য আকাশবাণী থেকে বর্ষসেরা নাট্যকারের সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন তিনি।
ডাঃ ভট্টাচার্যর শব্দ চয়ন, ভাষাজ্ঞানও অনবদ্য। ‘খাবার নিয়ে ভাবনা’ বইটিতে মূলত তিনি বলতে চেয়েছেন খাবারদাবার নিয়ে আমাদের যেসব ভ্রান্ত ধারণা আছে সেগুলির সম্বন্ধে। আমরা সবাই চাই সুস্থ স্বাভাবিক নীরোগ হয়ে জীবনযাপন করতে। কিন্তু দৈনন্দিন কিছু খাদ্যাভ্যাস আমাদের অজান্তেই জীবনে নিয়ে আসে অসুস্থতা। খুবই সাবলীল ভাষায় তিনি আমাদের জানিয়েছেন, শরীরকে সুস্থ সঠিক রাখতে গেলে, এমন কি দীর্ঘদিন তারুণ্য বজায় রাখতে গেলে আমাদের কী খাওয়া উচিত, কি খাওয়া উচিত নয়, কখন, কতটা পরিমাণে তা খাওয়া যায় ইত্যাদি। বইটির ছত্রে ছত্রে তিনি নানা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

মা-ঠাকুমার আমল থেকে আমরা সকলেই জেনে এসেছি গরমকালে বেশি ডিম খেলে শরীর গরম হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল তা দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক এই বইটিতে। এমনকি ডিমের মধ্যে কী কী উপাদান কতটা পরিমাণে রয়েছে তাও তিনি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন। ডিম খাওয়া নিয়ে তাঁর পরামর্শ, চিকিৎসকের বারণ না থাকলে প্রতিদিন একটা করে ডিম খাওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

আবার স্বাস্থ্য সচেতন অনেক মানুষই এখন মনে করে থাকেন, মাটন বা চিকেন দুটোই প্রোটিনসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাদ্য হলেও মাটনের থেকে চিকেন খাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ। কিন্তু লেখক এই বইয়ের তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পুষ্টিমূল্যের দিক থেকে মাটন ও চিকেন প্রায় কাছাকাছি। এগুলিতে ১১০ থেকে ১২০ কিলো ক্যালরি আছে। প্রোটিন আছে ২০ থেকে ২৭ গ্রাম। এমনকি, মাটনে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, আয়রন প্রভৃতি নানা খনিজ বেশি পরিমাণে আছে। কিন্তু মুশকিল হল, মাটনে পুষ্টিমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাটও আছে অনেক বেশি পরিমাণে। তাই বেশি মাটন খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।

কিন্তু যদি নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়া যায় তাহলে যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও মাটন এবং চিকেন পছন্দ মতো খেতেই পারেন। তাই তাঁর পরামর্শ শরীরে বড় কোনও অসুখ না থাকলে সপ্তাহে দু-তিন দিন দু’ চার টুকরো মাটন খাওয়াই যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

অনেক সময় আমরা মনে করি, দেহে এবং মাথায় সরষে তেল মাখা খুবই উপকারী। কিন্তু ডাঃ ভট্টাচার্যের পরামর্শ, কখনই সর্ষের তেল মাথায় এবং শরীরে সারা বছর লাগানো উচিত নয়। কারণ, আমরা হয়তো জানি না, ত্বকের পুষ্টির জন্য কোনও তেলই অপরিহার্য নয়। ত্বকের পুষ্টি আসে আমরা যে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করি তাতে যে তেল এবং চর্বি আছে তার মাধ্যমে। তিনি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন, প্রায় গত ৪৫ বছর ধরে তিনি শরীরেও মাথায় তেল না লাগিয়েও বেশ তেল চুকচুকে আছেন।

তবে শীতকালে তেল শরীরে মাখাই যায়। কিন্তু কখনই সরষে তেল শরীরে মাখা যাবে না। কারণ সরষে তেল আমাদের ত্বকের ক্ষতি করে। সরষের তেল মেখে বাচ্চাদের দীর্ঘক্ষণ রোদে রাখলে ত্বকের রং কালো হয়ে গিয়ে ত্বক পুড়ে যেতে পারে। আমরা অনেক সময়ই মনে করে থাকি, নাকে বা কানের ফুটোতে তেল দেওয়া উপকারী। কিন্তু এ সবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২১: আবার কালাদেও?

লেখকের পরামর্শ, যদি মাখতেই হয় তাহলে নারকেল তেল কিংবা অলিভ অয়েল মাখা যেতে পারে। স্নানের আগে তেল মেখে নিলে তেল ধুয়ে যায়। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হল, তেল আগে না মেখে স্নান করে সারা শরীরে নারকেল তেল বা কোনও ময়শ্চারাইজার মেখে নেওয়া। আবার কেউ কেউ মেন করেন নারকেল তেল গায়ে মাখলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

ডাঃ ভট্টাচার্য বলছেন, সুগন্ধিযুক্ত কোনও ক্রিম বা তেল কখনওই শিশুদের মাখানো উচিত নয়। আর যদিও বা মাখানো হয়ে থাকে তাহলে শিশুকে বেশি দলাই-মালাই করা যাবে না। কারণ, শিশুদের মাংসপেশী নরম থাকে। এই অতিরিক্ত চাপের ফলে তাদের তন্তু ছিঁড়ে যেতে পারে। তাই সর্ষের তেল আমরা অন্যান্য তেলের পরিবর্তে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেও, শরীরের জন্য তা একদমই আদর্শ নয়।

এরকমই আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একাধিক বিষয়ে যে সব ভ্রান্ত ধারণা আছে, তা নিয়ে ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য তাঁর ‘খাবার নিয়ে ভাবনা’ বইয়ে বিজ্ঞানসম্মত ও পরিশীলিত ভাষায় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘খাবার নিয়ে ভাবনা’ বইটি প্রতি পরিবারে রাখার মতো একটি বই। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত এই বইটির দাম ১৯৯ টাকা।
* বইয়ের দেশে (Book Reviewy): ড. সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content