শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


দুই থেকে চার মিটার উঁচু জোয়ারের জল ছাপিয়ে যায় নদীর দু’পাশের প্লাবনভূমি।

১৯৭৮ সালের কথা। তখন আমার বয়স ন’বছর। বাড়ির সামনে খালের ঠিক ওপারে বড় রাস্তার পাশে পানীয় জলের একটা নলকূপ বসানো শুরু হল। সবাই খুশি, কারণ এতদিন আমাদের পানীয় জল আনতে হত প্রায় এক কিলোমিটার দূরের নলকূপ থেকে। গ্রামের আটটা পাড়ার জন্য একটাই নলকূপ। জল নেওয়ার জন্য দিনভর মানুষের লাইন লেগেই থাকত। আর সেই নলকূপ খারাপ হয়ে গেলে যেতে হত প্রায় দু’ কিলোমিটার দূরের আর একটা নলকূপে। সত্তরের দশকে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে এমনই ছিল পানীয় জলের ব্যবস্থা। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াইশো ফুট দূরে যেহেতু নলকূপ বসানো হচ্ছে তাই নলকূপ বসানোর কৌশল দেখা ছিল আমার সেই কয়েকদিনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। সারাদিন ও রাত ধরে মাটির তলায় পাইপ পোঁতার কাজ চলত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়াতাম নতুন নলকূপের কাছে।
একদিন গিয়ে দেখি পাইপ পোঁতার কাজ বন্ধ। শুনলাম মাটির গভীরে নাকি পাথর পড়েছে। আর তাতে মাটি কাটার ফলা ভেঙে গিয়েছে। আবার সব পাইপ তুলে নতুন করে পাইপ পুঁততে হবে। মাটির তলায় পাথর আছে? কিন্তু ছোট থেকে বাবার মুখে তো শুনে এসেছি যে এখানে একসময় ছিল সমুদ্র। পলি জমে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এ কথা অবিশ্বাসও করিনি কারণ পুকুর খনন করার সময় দশ-বারো ফুট গভীরে গেলেই সাদা বালি ও নোনা জল উঠতে দেখেছি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৯: কেস জন্ডিস

কিন্তু পাথর কেন থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর তখন আমার কাছে ছিল অজানা। কিন্তু প্রশ্নটা মন থেকে হারিয়ে যায়নি। এ প্রশ্নের উত্তর পেলাম অনেক পরে, পরিণত বয়সে। সুন্দরবনের পলিস্তরের নীচে পাথরের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সুন্দরবনের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস।
আজ সুন্দরবনের ভূভাগের উপর দাঁড়িয়ে কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে যদি কুড়ি কোটি বছর পিছিয়ে যাই তখন দেখবো প্রাচীন পৃথিবীর দক্ষিণ মহাদেশ গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ ছিল সুন্দরবনসহ পুরো ভারত ভূখন্ড। এই মহাদেশের উত্তরে ছিল লরেশিয়া মহাদেশ। আর মাঝে টেথিস মহাসাগর। তারপর সাড়ে চোদ্দো কোটি বছর আগে পাঁচ খণ্ডে ভেঙে গেল অতিকায় গন্ডোয়ানাল্যান্ড।

এই পাঁচ খণ্ডের অন্যতম হল ভারতীয় পাত। এর পর ভূগর্ভস্থ লাভাস্রোতের টানে অন্যান্য পাতগুলির মতো ভারতীয় পাতও সরতে শুরু করে। এর অভিমুখ হয় উত্তর দিকে। ছয় কোটি বছর আগে ভারতীয় পাত এসে ধাক্কা দেয় উত্তরের ইউরেশিয়া পাতকে। ফলে টেথিস সাগরের পলি উঁচু হয়ে জন্ম নেয় হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা। ভারতীয় পাতের পূর্বাংশ জুড়ে গেল ব্রহ্মদেশীয় পাতের সঙ্গে। আর এ ভাবে ভারতীয় পাতের পূর্বদিকে তৈরি হল এক নিম্নভূমি অঞ্চল যা ‘বেঙ্গল বেসিন’ নামে পরিচিত।

কুড়ি কোটি বছর আগে সুন্দরবন ছিল গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ।

এই নিম্নভূমির পূর্ব সীমানা ছিল ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের মালভূমি, পশ্চিম সীমানা রাজমহল পাহাড়, উত্তর-পূর্বে মেঘালয় মালভূমি এবং উত্তরে সদ্য সৃষ্ট হিমালয়। তখন এই ‘বেঙ্গল বেসিন’ ছিল বঙ্গোপসাগরের অগভীর জলভাগ। বঙ্গোপসাগরের নোনা জল আজ থেকে ছ’ কোটি বছর আগে হিমালয়ের পাদদেশ ছুঁয়ে যেত। আজকের তরাই-ডুয়ার্স এলাকায় ছিল ম্যানগ্রোভ অরণ্য। তারপর আজ থেকে ১৮ লক্ষ বছর আগে যখন হিমযুগ শুরু হল তখন বঙ্গোপসাগর গেল অনেক পিছিয়ে। জেগে উঠল বেঙ্গল বেসিন। ১২ হাজার বছর আগে শেষ হল হিমযুগ। আবার বাড়তে শুরু করল উষ্ণতা। তখন হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

সেই বরফগলা জল নিয়ে বেঙ্গল বেসিনের দিকে ধেয়ে এলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। জলের সঙ্গে আসতে লাগল বিপুল পরিমাণ পলি। এই সময় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতও শুরু হল। ফলে বছরে ২৫০ কোটি টন পলি নিয়ে এই তিন প্রধান নদী ও তার শাখা নদীগুলি বেঙ্গল বেসিনের অবনমিত শিলাস্তরের উপর পলি সঞ্চয় করতে থাকল। জন্ম নিল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা। আর এই অববাহিকার দক্ষিণতম প্রান্ত হল বর্তমানের সুন্দরবন। এই অংশের গঠন প্রক্রিয়া আজও চলছে। তাই অবনমিত শিলাস্তরের ওপর পলিস্তরের পুরুত্ব অনেক কম। নলকূপ বসানোর সময় যে শিলাস্তরে ঠোক্কর খেতে হয় তা হল ওই অবনমিত শিলাস্তর।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬০: গ্রাম বাংলায় আমুর কার্প মাছের বীজ উৎপাদন করে ভালো রোজগার করা সম্ভব

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

এটুকু বোঝা গেল, দু’ কোটি বছর আগে যে বঙ্গোপসাগর হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল তা ক্রমশ পিছোতে পিছোতে আজকের অবস্থানে এসেছে বিস্তৃত বেঙ্গল বেসিনে পলি সঞ্চয়ের ফলে। তবে এতদিন ধরে যা পলি সঞ্চিত হয়েছে তার মাত্র ছয় শতাংশ এলাকা স্থলভাগ হিসেবে জেগে আছে, বাকি বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও নিমজ্জিত রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকে।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের শাখা নদীরা যে বিপুল পরিমাণ পলি বয়ে নিয়ে আসছে তার বেশিরভাগই বর্তমানে সঞ্চিত হচ্ছে পূর্বদিকে। কারণ এই বেঙ্গল বেসিন হেলে রয়েছে পূর্বদিকে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলের মানচিত্র দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে গঙ্গা-মোহনার স্থলভাগ ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা মোহনার স্থলভাগের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষিণে প্রসারিত। এর কারণ বেঙ্গল বেসিনের ঢাল। অনেক কম পলিতেই গঙ্গা-মোহনায় অনেক বেশি দ্বীপ তৈরি হয়েছে।

গঙ্গা-মোহনার স্থলভাগ ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা মোহনার স্থলভাগের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষিণে প্রসারিত।

কীভাবে জমল এই পলিরাশি?
বন্যার কারণে দু’পাশের প্লাবনভূমিতে যে পলি জমে তা সবাই জানি। কিন্তু সুন্দরবনের স্থলভাগ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বন্যার তেমন ভূমিকা নেই। নদীবাহিত পলিরাশি বঙ্গোপসাগরের জলে মেশার পর জোয়ারের জলের সঙ্গে সেই পলি ফিরে আসে নদীর মোহনায়। দুই থেকে চার মিটার উঁচু জোয়ারের জল ছাপিয়ে যায় নদীর দু’পাশের প্লাবনভূমি। ফলে সেই পলি সঞ্চিত হয় প্লাবনভূমিতে।

নোনাজলের পলি যখন নদীর মিষ্টি জলের সংস্পর্শে আসে তখন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ওই পলি দ্রুত জমাট বাঁধতে শুরু করে। তারপর ওই পলিকে দু’পাশের প্লাবনভূমিতে জন্মানো ধানি ঘাসের শেকড় আঁকড়ে ধরে। ফলে ভাটার সময় ওই পলি সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে না। দিনে দু’বার জোয়ার হওয়ার ফলে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পলি প্লাবনভূমিতে সঞ্চিত হয়। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে বেঙ্গল বেসিনের দ্বীপমালা যা বর্তমানকালের সুন্দরবন। —চলবে
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content