শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

মারীচ জন্মসূত্রে যক্ষপুত্র, এক জীবনে সে নরমাংসলোলুপ রাক্ষস থেকে ফলমূলজীবী সন্ন্যাসী। সৌন্দর্য এবং কলুষতা, হিংসা এবং শান্তি, লুব্ধতা এবং বৈরাগ্যের সকল পাঠ সে এক জীবনেই পেয়েছে। তাই তার বুঝি মরণের পানে ছুটে যেতেও আর দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয় নেই। মহাবিক্রম ভয়াল দশানন রাবণকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতেও তার ভয় নেই যে—“জনকাত্মজা সীতা আপনার প্রাণনাশের জন্যই জন্ম নেননি তো?” রাবণের পরাক্রমের কাছে নতি স্বীকার করেও কঠোর বাক্যে ভর্ৎসনা করতে পারেন— “হে রাজন, কে আপনাকে এই মৃত্যুর খোলা দরজাটি দেখিয়ে দিল? কোন সচিব আপনার অন্ন ভোগ করেও এই স্বেচ্ছাচারের পথে এগিয়ে দিল?”

হিতাকাঙ্ক্ষী মারীচের এত কথা কিন্তু রাবণের কর্ণগোচর হল না। তার বহু চেষ্টা বিফলে গেল। সীতাহরণের বিষয়ে রাবণ নিজের সংকল্পে অবিচল থাকলেন। মারীচ নিজের আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় ডুব দিল এবারে। তার এখন অন্তরে ভয়, উদ্বিগ্নতা যেন নতুন করে জেগে উঠল। রাবণের সঙ্গে রথে উঠে বসল সে বাধ্য হয়ে। নানা দেশ পার হয়ে অবশেষে তাঁরা দণ্ডকারণ্যে এসে উপস্থিত হলেন।
অরণ্যের মধ্যে দূর থেকে চেনা যাচ্ছে কদলীবৃক্ষে পরিপূর্ণ রামের আশ্রম। রাবণ বিলম্ব করতে চাইলেন না। রথ থেকে নেমেই মারীচকে বললেন— “বন্ধু,যে কাজে এসেছি, সে কাজ শীঘ্রই সম্পন্ন করো।” রাবণের কথা শুনে মারীচ নিরূপায় হয়ে সেই মুহুর্তেই বিচিত্র রূপধারী স্বর্ণমৃগে পরিণত হল। শত শত রূপোর বিন্দু যেন তার সোনার বরণ দেহে আলোকবিন্দুর মতো জ্বলজ্বল করে উঠল। নীলমণি আর স্ফটিকমণির মতো বিচিত্র বর্ণময় চিত্রে, পদ্মাকার চিহ্নে অলঙ্কৃত সেই হরিণ। মাথায় দুটি নয়, চারটি স্বর্ণশৃঙ্গের মণিময় শোভা।

এমন অদৃষ্টপূর্ব হরিণের রূপ ধরে মায়াবী মারীচ তার জীবনের শেষ মায়ার খেলাটি দেখানোর জন্যই যেন আশ্রমের দ্বারপ্রান্তে এসে চরতে শুরু করল। সীতার চোখে রূপের মায়া ধরাতে হবে যে তাকে, ভোলাতে হবে সীতার মন। মারীচ জানে এভাবেই তার প্রভু রাবণের আজ্ঞা পালন করতে হবে তাকে। আবার সে এও নিশ্চিত রূপে জানে, এ রূপের মায়াজালে লুকিয়ে আছে তার মৃত্যুবীজ। রামের হাতের নিশিত বাণ থেকে তাকে উদ্ধার করবে কেই বা? নাকি রামের মৃত্যুবাণে স্বর্গ প্রাপ্তির আশাতেই এই কার্য বা প্রকারান্তরে অকার্যের আয়োজনে নিজেকে সঁপে দিয়েছে সে? মনোহারী সোনার হরিণ হয়ে বিচরণ করতে করতে মারীচ দেখতে পেল, রাজমহিষী সীতাকে। অস্তাচলগামী সূর্যের প্রভার মতো আশ্চর্য রমণীয় রূপ তাঁর।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৯: রাবণ-মারীচ সংবাদ এগোল কোন পথে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৫: কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ প্রাজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সর্বত্যাগীর কেন এই মায়াবন্ধন?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

এমন আশ্চর্য হরিণ! সীতা দেখে অভিভূত হয়ে ডেকে আনলেন রামকে। উৎফুল্ল তাঁর নেত্র, আনন্দে উদ্ভাসিত তাঁর মুখশ্রী। —“আর্যপুত্র, আমাকে দাও না এনে হরিণটি। একে যদি জীবন্ত ধরে আনতে পারো, তাহলে বনবাসের পরে রাজধানীতে নিয়ে যাবো। অন্তঃপুরের শোভা বৃদ্ধি করবে এমন আশ্চর্য প্রাণী। সবাই অবাক হয়ে যাবে। আর যদি জীবন্ত ধরতে না পারো তাহলেও একে পেতে চাই আমি। তৃণাসনের উপর এমন স্বর্ণময় মৃগচর্ম বিছিয়ে বসব। আমি জানি, নারীর পক্ষে অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বাক্য বলছি আমি, কিন্তু হরিণটিকে দেখে বড় লোভ হচ্ছে। তার জন্যই আমার মনে এমন ভাবনা উঠে আসছে।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

রামও বিস্মিত হয়েছেন হরিণের এমন রূপ দেখে। লক্ষ্মণকে ডেকে দেখালেন হরিণটিকে। প্রিয়া বৈদেহীর এমন ইচ্ছা পূরণ করতে উৎসাহী হয়ে উঠলেন তিনি। লক্ষ্মণকে বললেন— “ভাই, বৈদেহীর বড় শখ হয়েছে হরিণটিকে পাওয়ার জন্য। এই কাঞ্চনচর্মে বৈদেহী বসতে চেয়েছে। আর হবে নাই বা কেন? কুবেরের চৈত্ররথ বনেও এমন আশ্চর্য প্রাণী নেই। হরিণটি হয়তো আজ প্রাণে বাঁচবে না। আমার বাণেই ওর মৃত্যু নিশ্চিত। আর যদি এই হরিণ কোনও রাক্ষসের মায়া হয়, তাহলে তাকে শীঘ্রই বধ করা আমার কর্তব্য। আমাকে যেতেই হবে এ কাজে। লক্ষ্মণ, আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি, ততক্ষণ সীতাকে রক্ষার ভার তোমার। তুমি এখান থেকে কোথাও যাবে না সীতাকে রেখে।”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

চলো যাই ঘুরে আসি: পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

লক্ষ্মণের মনের মধ্যে তখন সংশয়। সত্যই কি এমন সোনার হরিণ এসেছে আশ্রমদ্বারে নাকি এ মায়াবী রাক্ষস মারীচের ছলনা? অগ্রজকে বাধা দিতে চায় সে। অনুরোধ করে সোনার হরিণের অস্তিত্বের বিষয়টি ভালো করে অনুধাবন করার জন্য।

এদিকে সীতার মনে তখন দুর্বার হয়ে উঠেছে হরিণের আকর্ষণ। মনোহরণ, চপলচরণ সোনার হরিণ যে তাঁর চাইই। জীবন্ত না পেলেও অন্তত মৃগচর্মটির প্রতি মনের দুর্বাধ্য লিপ্সা রোধ করতে পারেননা তিনি। রাম আর দ্বিধা করেন না। সোনার শরাসন হাতে, মহাতূণীর পিঠে নিয়ে, স্বর্ণখচিত তীক্ষ্ণ তরবারি নিয়ে ছুটতে শুরু করেন সোনার হরিণের পিছনে। রামকে দেখে মায়াবী মারীচ ছুটতে থাকে দ্রুত, অরণ্যের পথে বিপথে। মনের থেকে, বায়ুর থেকেও এখন তার গতিবেগ বেশি। কখনও সে দেখা দেয়, কখনও আবার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে দৃষ্টিভ্রম ঘটাতে থাকে রামের। মায়ার খেলা শুরু হয় দণ্ডকারণ্যের আলোয় আঁধারে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content