শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


দেবরাজ ঘোষ। মানে আমার প্রকাশক দেবরাজ বাবু গুণী ব্যবসায়ী, সেই সঙ্গে অত্যন্ত করিৎকর্মা একজন সংগঠক। আমার লেখার শোনার জন্য দুর্গাপুরে উনি এত লোক জমা করতে পারবেন এটা আমি আশাই করিনি। শুধু লোক জড়ো করা নয় এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গুণী মানুষজন রয়েছেন আজকের শ্রোতৃমন্ডলীর মধ্যে। ডাক্তার, প্লান্টের হোমরাচোমরা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আধিকারিক রাজনৈতিক নেতা স্থানীয় একটি ব্যান্ডের সদস্য থিয়েটার গ্রুপের কর্মী ও পরিচালক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং স্টিলপ্ল্যান্টের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। অবশ্য নির্দেশ মেনে আমজাদ শেখ অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। একটা ছোট্ট মুখবন্ধ এবং আমাকে বরণ করে নেওয়া এসবের পর সরাসরি আমার উপন্যাস পাঠ শুরু হল। আজ আমি আমার নতুন উপন্যাস ‘ক্যানভাসে রক্তের দাগ’ থেকে নির্বাচিত অংশ পড়ে শোনাবো।

এই বইটার কভার পেজের বিজ্ঞাপন দিয়ে সুদৃশ্য স্ট্যান্ডি হোটেলের লবিতে এবং এই ব্যাঙ্কোয়েট হলের চারদিক সাজানো রয়েছে। অডিটোরিয়াম স্টাইলের চেয়ার সাজানো। বাঁদিকে সাজানো রয়েছে সান্ধ্যভোজনের উপকরণ। চা কফি সহযোগে প্রচুর পরিমাণে টা। আর ডানদিকে লম্বা টেবলের উপর রয়েছে মূলত আমার প্রকাশিত বিভিন্ন বই এবং সেই সঙ্গে দেবরাজ বাবুর প্রকাশনার সংস্থার আরও অনেক বইয়ের কপি রাখা রয়েছে। শ্রোতা-দর্শকের ইচ্ছে হলে তার বই কিনতে পারেন। আমার বই কিনলে পাঠককে আমি নিজে স্বাক্ষর করে একটা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দেব। এটাই নিয়ম।

তবে সে সম্ভাবনা কম। ক্যানভাসে রক্তের দাগ একজন পেইন্টার বা চিত্রকরকে নিয়ে টানটান রহস্য উপন্যাস। উপন্যাস পড়তে পড়তে বুঝতে পারছি শ্রোতারা অত্যন্ত মনসংযোগ করে শুনছেন। যখন আমি খুব পরিচিত হইনি তখনও আমার পাঠের সময় শ্রোতাদের কখনও অমনোযোগী হতে দেখিনি। তবে সেটা লেখার গুণ না বলার সেই তুল্যমূল্য বিচারে যাইনি। এখন বিনোদনের এত রকমারি উপকরণ। মুঠোর মধ্যে দেশ-বিদেশের খবর, বিশুদ্ধ নিষিদ্ধ মনোরঞ্জনের ব্লকব্লাস্টার আয়োজন। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির টক-ঝাল কতবেল। এটা সত্ত্বেও এত মানুষের মনে অল্প সময় হলেও প্রভাব বিস্তার করতে পারাটাই একটা দারুণ সাফল্য।
উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ পড়া শেষ হল। এবার দেবরাজবাবুই একটা প্রশ্নোত্তরের অধ্যায় শুরু করলেন। আমার লেখা নিয়ে প্রশ্ন এই উপন্যাসের চরিত্রদের নিয়ে তাদের গঠন তাদের প্রস্তুতি নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং আমার উত্তর। মানুষের এটা বেশ ভালো লাগে। আমি এবং দেবরাজবাবু রাজ্য এবং দেশের নানান জায়গায় এই প্রশ্নোত্তর পর্ব করে দেখেছি লোকজন বেশ মজা পান উপভোগ করেন। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই এক দুজন উৎসাহী দর্শক প্রশ্ন করেন। এতদিনে বার তিনেক শুনেছি।

—আপনি বিয়ে করেননি কেন?

এর উত্তরটা আমার তৈরিই থাকে। তবে মজা করার জন্যই প্রথমে একটু অস্বস্তির অভিনয় করি। আমি মাথা নিচু করি। আমার হাতে ধরা বইয়ের কয়েকটা পাতা ওল্টাই তারপর মুখটা একটু বিষণ্ণ করে বলি।

—এসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না ওঠাই ভালো।

দেবরাজবাবু প্রতিবারই আমাকে চেপে ধরার মতো করে বলে ওঠেন।

—লেখক পাঠকের সম্পত্তি। লেখকের খোলা বইয়ের মতই পাঠক লেখকের জীবনচর্চা জীবনযাপন জানতে চান। আপনার একান্ত আপত্তি থাকলে ঠিক আছে না হলে উত্তরটা জানতে পারলে এই দর্শকের সঙ্গে আমারও ভালো লাগতো।

আমি তখন একটু লজ্জা লজ্জা করে মুখে হাসি এনে বলি।

—আসলে আমি এখনও খুঁজে চলেছি উপযুক্ত কাউকে পেলেই বিয়ে করবো।

প্রায় সব জায়গাতেই এরপর একটা হাসির হল্লা ওঠে দেবরাজবাবু সুযোগ বুঝে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং উপস্থিত দর্শককে চা-কফি জলযোগের জন্য আমন্ত্রণ জানান।

কিন্তু সেদিন একেবারে শেষ রো-তে বসে থাকা কালো বোরখা ঢাকা এক মহিলার প্রশ্নে এতদিনের রীতিটা থমকে গেল। কপাল আর নাকের ওপর কালো কাপড়ের আব্রু। মাঝে শরীরের দৃশ্যমান উজ্জ্বল ফরসা অংশটুকুতে শুধু গভীর কালো বাঁকা ভ্রু আর উজ্জ্বল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।

কাটা কাটা উচ্চারণে থেমে থেমে কথা বলেন সেই অনাম্নী অঙ্গনা।

—একটা প্রশ্ন ছিল? করতে পারি?

—স্বচ্ছন্দে।

—এতবছরে সত্যি কাউকে খুঁজে পাননি?

—বললাম তো।

—না মানে আপনি লেখেন। এত মানুষকে মিট করেন। এত মানুষের মধ্যে পছন্দসই কাউকেই পেলেন না? নাকি পেয়েও হারিয়ে ফেলেছেন?
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৬: সাদা ধবধবে মার্বেলের ওপর ভিজে পায়ের ছাপ ওয়াশরুম থেকে ঘরের দিকে গিয়েছে

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

আমি প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলাম। এই মহিলা এই প্রশ্ন করছেন কী করে? উনি কি কোনওভাবে আফিফাকে চেনেন? আমাকে সত্যি সত্যি বিব্রত হতে দেখে দেবরাজবাবু নিজে পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হলেন।

—আমি বলেছিলাম পাঠক লেখকের জীবনচর্চা জীবনযাপন জানতে আগ্রহী কিন্তু এটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

—বেশ আমি অন্য প্রশ্ন করছি। আপনার দুটি গল্পে খুন হয়ে যাওয়া মানুষটির আত্মা খুনিকে ধরিয়ে দিয়েছে। আপনি কি সত্যি সত্যি আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন?

—আমার অত্যন্ত নিবিষ্ট পাঠক এটা বুঝতে পারছি কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ধরনের প্রশ্ন কেউ আমাকে করেননি।
আমি সময় নষ্ট না করে বলে উঠলাম।

—আগে হ্যাঁ। আমি আস্তিক এবং আমি আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী।

দেবরাজ বাবু আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালেন এবং উপস্থিত সমস্ত দর্শককে ডেকে নিলেন যেখানে খাবার সাজানো আছে সেই দিকে।

আমি অনেকক্ষণ পিছনের দিক থেকে সামনের দিকে তাকিয়েও সেই কালো বোরখাপরা অনাম্নী অঙ্গনাকে খুঁজে পেলাম না। এখানে অঙ্গনা অবশ্য নারী অর্থে। মহাভারতে উল্লেখিত রাণি অম্বিকার পরিচারিকা বুদ্ধদেব বসু’র “অনাম্নী অঙ্গনা” নয়। যাই হোক সবাই এই ধরনের আথিত্য গ্রহণ করেন না। হিজাবে ঢাকা তিনিও হয়তো তেমন কেউ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন বেশ কয়েকটা বই বিক্রি হয়েছে। শুভেচ্ছা বার্তা লিখে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। উৎসাহী পাঠকদের সঙ্গে সেলফি তুলতে হয়েছে। কর্পোরেট ভাষায় মিশন সাকসেসফুল। এসব করতে করতে খানিকটা রাত হল। দেবরাজ বাবুর একটু সান্ধ্যপানের অভ্যাস আছে। আমার ইচ্ছে থাকলেও কোনো উপায় নেই। ডাক্তারবাবু বড্ড কড়া। বলে দিয়েছেন— “আমার কথা শুনে না চললে আপনার স্বপ্নভঙ্গ হবে। জনপ্রিয় লেখক হবার কোন সুযোগই থাকবে না। আপনার হৃদয় আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।”

এসব শোনার পর বিদ্রোহ করবো এত বড় বিপ্লবী আমি নই। টাটকা ফলের রস সঙ্গে নিয়ে দেবরাজবাবুকে সঙ্গ দিলাম। ডিনার শেষ হলো। গুডনাইট করে যে যার ঘরে ফিরব। কাল সকাল বেলায় মানে পৌনে আটটা নাগাদ হাওড়া থেকে আসা শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে দেবরাজ ঘোষ সহকারি আমজাদ শেখকে নিয়ে যাবেন বোকারো স্টিল সিটি। ওখানেও ওঁর এই একই ধরনের অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে আছে। কলকাতা থেকে আসার সময় রাস্তায় গাড়িতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। তাই বোকারো ট্রেনে গিয়ে আবার ট্রেনে ফিরে আসবেন। তারপর দুর্গাপুর থেকে গাড়িতে কলকাতা। আমি ফিরব রাঁচি হাওড়া শতাব্দী এক্সপ্রেসে। সন্ধ্যে সওয়া সাতটা নাগাদ দুর্গাপুর থেকে ছেড়ে রাত সাড়ে নটায় কলকাতায় পৌঁছে দেবে। একটি ট্যাক্সি নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে পৌঁছতে মেরে কেটে সোয়া দশটা। মাকে ফোন করে বলে দিয়েছি কাল রাতে ফিরে আলু পটলের ঝোল দিয়ে ভাত খাব। রুই মাছ ভাজা।

ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়ার পরেও ঘুম আসছিল না। সন্ধ্যেবেলা ব্যাংকয়েটে এই যে মেয়েটি হঠাৎ করে আফিফার দগদগে স্মৃতিকে খুঁচিয়ে দিল সে কে? হঠাৎ আমার মনে হল আদৌ কি কেউ ওই প্রশ্নটা করেছিল? বা দেবরাজ বাবু ওভাবে উত্তর দিয়েছিলেন? নাকি পুরোটাই আমার মনের ভুল। দুপুরে লাঞ্চ খেতে যাবার আগে ওয়াশরুমে চানের জায়গার ভেতরে কাকে দেখেছিলাম? সেটা কি সত্যি? পর্দাঘেরা চানের জায়গার ভেতরে শুকনো মেঝেতে ভিজে পায়ের ছাপ দেখেছিলাম ঘরের দিকে যেতে। সেটা? এ বার একটু একটু করে মনে হচ্ছে একটা সাইকোলজিস্টকে দেখিয়ে নেওয়াটা উচিত হবে। আর সত্যিই তো থেরাপি নেওয়া মানেই পাগলের চিকিৎসা নয়। তবে মাকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৪: সতী ও অসতী মাঝে পিতৃতন্ত্র

হঠাৎ আমার ঘরের ফোনটা বেজে উঠলো। এত রাতে কার ফোন? মার শরীর খারাপ-টারাপ হল না তো? আমাদের বাড়িতে যিনি কাজ করেন তার নাম বা পদবি আমি জানি না। বহুদিন আমাদের বাড়িতে কাজ করেন। আমার ছোটবেলা থেকেই রয়েছেন। এখন বয়স হয়ে গেছে। তাকে আমরা বামুন বউ বলি। আমার কোথাও যাওয়ার থাকলে আগে থেকে বলে রাখি বামুনবউ মা’র কাছে থাকে।

তড়িঘড়ি করে ফোন ধরলাম।

—হ্যালো।

—ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?

গলার আওয়াজ শুনে মায়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মা ঠিক আছে এটা অন্য ফোন। কিন্তু বড় অদ্ভুত লাগলো বাইরে থেকে কেউ ফোন করলে আগে রিসেপশন আমাকে জিজ্ঞেস করে কলটা কানেক্ট করবার কথা। তা না করে তা না করেই মহিলা আমায় সরাসরি ফোন করলেন কি করে?

—এত অবাক হচ্ছেন কেন? আপনার রুম নাম্বার এক্সটেনশন ডায়াল করতে সরাসরি পেয়ে গেলাম।

এ বার আমি সত্যিই চমকে উঠলাম। আমি কি ভাবছি সেটা উনি বুঝলেন কি করে? আর এই গলাটা তো আমার চেনা। সন্ধ্যেবেলা ব্যাংক উঠে ব্যাংকোয়েটে ইনিই আমায় প্রশ্নটা করেছিলেন? তিনিই সেই বোরখাপরা অনাম্নী অঙ্গনা।—চলবে

হিজাব পরা সেই অনাম্নী অঙ্গনা।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content