রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


চিত্র সৌজন্যে: সত্রাগ্নি

।। শিকার ও শিকারি ।।

শিশু-কিশোর প্রাইমারি সেকশনের হায়না বা বাঘেরা যেমন অভ্যাস করতে করতে করে শিকার করা শেখে, শিবানীর মতো শিকারি মেয়েরাও ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে পুরুষকে বশ করে নিজের কাজে লাগাতে শেখে। কোন অবস্থায় ঠিক কোন রং-ঢং-নখরা কাজে লাগবে এদের সেগুলো অভ্যেস করতে করতেই রপ্ত হয়ে যায়। তখন বয়সে দু’ আড়াই গুণ বড় পুরুষমানুষকেও ঘোল খাওয়াতে কোনও অসুবিধেই হয় না। যেমন এখন। বুল্টি বলার চেষ্টা করেছিল—

—তোর সঙ্গে কি আমার টাকার সম্পর্ক শিবানী?

শিবানী কপালটা একটু নিচু করে নিজের ভ্রু বরাবর তাকিয়ে বুল্টিকে যেন দগ্ধ করে।

—কে হই আমি তোমার?

—তুই আমার বোনের মতো

—বোনের মতো বুঝি?

—আচ্ছা বাবা ভাইঝিই হলি – তোর বাবা-মাকে দাদা-বৌদি ডাকি।

—ভাইঝি—হাঃহাঃহাঃ

শিবানী শব্দ করে হাসে। বুল্টি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে বোঝে মেয়েটা ভয়ানক সেয়ানা। বুল্টির মতো আধবুড়ো বিবাহিত পারভার্টরা ভীতু তারা জানে অন্যায় করছে। বেড়ালের মাছচুরি করার মতো চুরির ছোঁকছোঁকানিটা যায়নি। আর শিবানীরা লাজলজ্জাহীন বেপরোয়া। দুটো শ্রেণিই নিকৃষ্ট গোত্রের। তবে তুলনায় শিবানীদের লোভ আকাঙ্খা উচ্চাশা খুব বেশি। তাই এরা নাগ বশকরা বেদেনীর মতো ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সাপকে খেলাতে জানে।

বুল্টিকে ফাংশন প্রতি শতকরা কুড়ি পার্সেন্ট কমিশন দেবার হিসেবটা অন্য। আগে সপ্তাহে একটা ফাংশন পাওয়া যেত। এখন ফাংশন প্রতি নির্দিষ্ট রোজগার বাঁধা। সঙ্গে ফাউ শিবানীর ঘনিষ্ঠতা। ফলে এখন সপ্তাহে দুটো তিনটে করে ফাংশন আসছে। কমিশন দিয়েও লাভ প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে গিয়েছে।

বুল্টিরা ভাবে কম বয়সী শিবানীরা আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতেই পারছে না। তাকে পপুলারিটির নেশা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুল্টিরা ভাবতেই পারে না। মেয়েদের হাতে পায়ে গায়ের জোরের খামতির জন্যেই পুরুষদের থেকে তাদের উপলব্ধি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর। তাই বুল্টিকে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেয় শিবানী কিন্তু বেচাল হতে দেয় না। ছোবল দেওয়া তো দূরের কথা। বুল্টি তার রাগী বউ বা শিবানীর মা কোনওদিন জানতেও পারেনি যে, হাতের লেখা পালটে বেনামি চিঠি লিখে শিবানী নিজেই বুল্টির বউ’কে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। যাতে চুঁচুড়া থেকে বুল্টিকে ধরে শিবানী কলকাতা পৌঁছতে পারে। এরকম একটা রগরগে কেচ্ছা না হলে শুভ্রা কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে থাকতে যেত না। না হলে মাসমাইনের ড্রাইভার রতনের বুল্টির বিরুদ্ধে বলার সাহস হয়? ওটা বানানো চিঠিতেই বলা ছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২০: অনুষ্ঠানে শিবানী একাই গেল, বাড়িতে স্রোতের মতো টাকা ঢুকছে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

বুল্টির ভাবনা অনুযায়ী শিবানীর মাকে চুঁচুড়ায় ফিরতে হলো। সত্যিই তো অবসরপ্রাপ্ত স্বামী স্কুলপড়ুয়া মেয়ে কতদিনই বা শুভ্রা ঘরসংসার ছেড়ে এভাবে থাকবেন! কিন্তু তার মতলব হাসিল তাতে হলো না। শিবানীর এক দূরসম্পর্কের বয়স্কা বিধবা পিসি এসে কলকাতায় সেই বাড়িতে তার সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। স্টুডিয়োতে বুল্টির সঙ্গে তো দেখা হতোই। সেখানে শিবানী কাঁচুমাচু মুখ করে জানালো, তার মা শুভ্রার জোরাজুরিতেই নাকি দূরসম্পর্কের ওই আত্মীয়াকে শিবানীর কাছে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। বুল্টি ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না। শিবানী নিজেই আড়াল থেকে এসব কলকাঠি নাড়ছে। পাড়ায় পাড়ায় মাচার অনুষ্ঠান করাই বুল্টির মূল রোজগার। তাই রোজ রোজ শিবানীর সঙ্গে টালিগঞ্জের এ স্টুডিয়ো ও স্টুডিয়ো এবং স্টুডিয়োতে নানান অফিসঘরে ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আখেরে তার কোনও লাভ হচ্ছিল না। জানাশুনার সূত্রে কয়েকজন গানের শিল্পী জোগাড় হয়েছে। ছবিতে নায়কনায়িকাদের গানের সঙ্গে পিছনে নাচতে থাকা সহ শিল্পীদের মধ্যে নাচের অনুষ্ঠান করানোর মতো একদুজনের সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে গিয়েছে। স্টুডিয়োতে সারাদিন বসে থেকে আর দুটো নাচের দৃশ্যে অভিনয় করে যে পয়সা পাওয়া যায় তার চেয়ে সন্ধে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরতলীর বিচিত্রানুষ্ঠানের রোজগার বেশি। যাতায়াতের মধ্যেই এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে আলাপ হল যার সূত্রে ঘনঘন ছবিতে খলনায়কের পার্শ্বচরিত্রে মুখ দেখতে পাওয়া যায় এমন এক অভিনেতা-অভিনেত্রী জুটিকে “জনপ্রিয় চিত্রতারকা জুটি” বানিয়ে ফাংশনে স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্সে উপস্থিত করানো গেল। ফলে বুল্টি ক্রমশ টালিগঞ্জে স্টুডিয়োতে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়ল। দীর্ঘদিন যাতায়াতের ফলে শিবানী তখন অনেকটা সড়গড় হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৮: বুধন উধাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

কথায় বলে কারো পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। সিংহানিয়া বলে এক প্রযোজক তার ছবিতে চটুল গানে নাচার জন্য বোম্বে থেকে এক তৃতীয় শ্রেণির নর্তকীকে নিয়ে এসেছিল। খরচা করে সেট ফেলা হয়েছিল। নায়ক ব্যস্ত তাই গানের কিছু কিছু অংশ প্রথম দিন বম্বের সেই ড্যান্সার নিয়ে শুটিং করা হয়ে গেছে। নর্তকীকে নিয়ে টানা তিনদিনের শুটিং। দ্বিতীয় দিনে ব্যস্তনায়ক এসে যোগ দেবেন তখন নর্তকীর সঙ্গে নায়কের নাচের দৃশ্য গ্রহণ করা হবে। শিবানী জানে এই নাচগানে ফালি-টুকরো-তাপ্পি আলিবাবার বাবা মুস্তাফার মতো সেলাই করে জুড়ে একটা গোটা মারকাটারি ঝিনচ্যাক নাচগানের দৃশ্য তৈরি হবে, যা দেখে জনগণ সিটি দেবে পয়সা ছুঁড়বে উদ্দাম নাচবে।

কাজ থাকে না তাই রোজ কাজের আশায় আসা ছেলেমেয়েদের ভিড়ে মিশে শিবানীও এসব শুটিং দেখত। তারপর বোম্বের নর্তকী। সে কেমন শরীরী বিভঙ্গে নাচে সেটা দেখার একটা কৌতূহলও ছিল। বম্বের নর্তকীর ছুঁড়ে দেওয়া আগুনের উত্তাপ নিতে প্রযোজক সিংহানিয়া নিজেও হাজির।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৪: মানিকদা আমি ‘এজে’ আপনার থেকে বড়, কিন্তু আপনি ‘ইমেজে’ আমার থেকে অনেক বড়: জহর

মদের আসরে নর্তকী একাই নাচছে। তাই এই দৃশ্যে অতিরিক্ত সহশিল্পীদের প্রয়োজন নেই। নৃত্য পরিচালক বোম্বের। তার সহকারি কলকাতার। তাকে শিবানী চেনে। মানে শিবানী তাকে ছবি দিয়েছিল। সেদিন সঙ্গে বুল্টিদাও ছিল। সেদিন এই লোকটিকেই ছবি দেবার সময় বুল্টিদা ফাংশনে শিবানীর নাচ সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কথা বলেছিল। সেই সহকারী শিবানীকে বলেছিল গ্রুপ ডান্সের সুযোগ পেলে সে শিবানীকে ডাকবে। শিবানী তখন জানিয়েছিল দূরে ভিড়ের দঙ্গলের মধ্যে নয় যেখানে তাকে ক্যামেরাতে নায়ক বা নায়িকার আশেপাশে দেখা যাবে যাতে সিনেমায় অন্তত চেহারাটা চেনা যাবে সেরকম নাচের দৃশ্য থাকলে সে করতে রাজি আছে।

হোক না তৃতীয় শ্রেণির তবু বোম্বের তো! তাই আরবসাগর পাড়ের নর্তকীকে দেখতে স্টুডিয়ো চত্বরে বেশ ভিড় হয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে শিবানী দাঁড়াতে পারছিল না। সেই নৃত্য-সহকারি তাকে দেখতে পেয়ে ভিড়ের বৃত্তের ভেতরে এক জায়গায় দাঁড়াতে বললেন। শিবানী কৃতজ্ঞ।

রিহার্সাল দেওয়ার পর নাচ শুরু হল। রিহার্সাল করার পরেও একবার দু’ বার তিনবার রিটেকের পর রিটেক হচ্ছে। নর্তকী স্টেপ মেলাতে পারছে না। এরা বম্বের ছবিতে কাজ করতে অভ্যস্ত এরকম ভুল তো হবার কথা নয়। ডান্স ডিরেক্টর ছবির ডিরেক্টর প্রডিউসার সকলেই ব্যতিব্যস্ত। সমস্যাটা কী? গোড়ায় সমস্যাটা না বুঝতে পারলেও একজন ডান্সার হিসেবে শিবানী বুঝতে পারছে বম্বের নর্তকীর শরীর ঠিক নেই, তার শরীরের কোথাও একটা ব্যথায় সে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সে ব্যথা চেপে প্রাণপণে পারফর্ম করবার চেষ্টা করছে। কোন গতিকে খানিকটা অংশ শুটিং হল। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু শিবানী লক্ষ্য করছে সেই নর্তকী যেন এলিয়ে পড়ছে। আবার শুটিং শুরু হল এবার নর্তকী ডান্স ডিরেক্টরকে বললেন রিহার্সাল দরকার নেই একেবারে টেক করতে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গমগম করে গান বেজে উঠলো। এই দৃশ্যে নর্তকী টেবিলের ওপর থেকে গানের সুরে লাফ দিয়ে ফ্লোরে এসে নাচতে শুরু করবেন। নর্তকী সামান্য উঁচু টেবিল থেকে ফ্লোরে লাফালেন এবং সরাসরি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে লাগলেন।

স্বাভাবিকভাবে শুটিং ভেস্তে গেল ছুটোছুটি করে সেই নর্তকীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটল হাসপাতালে।—চলবে

ছবি: সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২২

…অ্যাপেনডিক্সের ব্যথা জানান দিল অপারেশন না করলে বড় শারীরিক ক্ষতি। অপারেশন হলে প্রযোজকের…ক্ষতি। ব্যস্ত হিরোর ডেট পাওয়া গড়া সেট ভাঙতে হবে। কিন্তু…অনেকেই …চিরঞ্জীতের মুখের সেই… সংলাপটা …বলল, “বউ গেলে বউ পাওয়া যায় রে পাগলা! মা গেলে মা পাওয়া যায় না।”—ছবি গেলে আবার ছবি পাবে! শরীর গেলে শরীর ফিরে পাবে না।।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content