শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ০১/০২/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ: শ্রী, প্রাচী ও ইন্দিরা

পরিচালনা: অগ্রগামী

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: অরুণাংশু

উত্তম সুচিত্রা যুগ চলছে। ‘সবার উপরে’ ব্লকবাস্টার হিট হয়েছে। এরকম একটা প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ‘সাগরিকা’ নামে একটি ছবি বাজারে মুক্তি পেল, যা আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলল।

ভাবলে অবাক লাগে, ‘অগ্রদূত’- র মতো পরিচালক গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে মাত্র দুজনের ঐকান্তিক চেষ্টায় আরেকটি পরিচালক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং সালতামামির নিরিখে এ বছরই অর্থাৎ একটা গোটা বছরে তাঁরা দুটি ছবি নির্মাণ করেন যেখানে নায়ক নায়িকার চরিত্রে উত্তম এবং সুচিত্রা। ইতিহাসেও ইতিপূর্বে এ ঘটনা ঘটেনি। যে কোন পরিচালক একটি বছরে একাধিক ছবি করলে তাঁরা প্লেয়ার কাস্টিং আলাদা আলাদা রাখেন বা যে কোনও একটি জুটিকে পরপর কয়েক বছর মনোনয়ন করেন। কিন্তু নবাগত পরিচালক গোষ্ঠী বাজারে এসেই উত্তম-সুচিত্রার মতো হেভি ওয়েট নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে ব্লকবাস্টার ছবি তৈরি করা মুখের কথা ছিল না। ‘অগ্রগামী’ গোষ্ঠী সেই চেষ্টাই করে দেখিয়েছিলেন।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি সূক্ষ্ম সমালোচনা এ অবস্থানে খুব জরুরি; যে সমস্ত চলচ্চিত্রবোদ্ধা অভিমত প্রকাশ করেন যে, উত্তম কুমারের মতো ক্ষণজন্মা প্রতিভা নামী পরিচালকের সাথে কাজ করার সুযোগ সেভাবে পাননি। যেখানে ওঁর থেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন অভিনেতারা অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছিলেন।

কথাটা বাক্যবাগীশদের মুখে মানালেও বাস্তবটা ছিল অনেক অন্যরকম। একজন যুগ-প্রবর্তক হিসাবে যে দায়িত্বের ভার উত্তমবাবুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছে তা খুব কম অভিনেতাকে করতে হয়েছে। নামী পরিচালকের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ যাঁরা পেয়েছেন তারা বাণিজ্যিক ছবির মোড় ঘোরাতে চলচ্চিত্রের নতুন আঙ্গিক নির্মাণে কোনও দায়িত্ব পালন করেননি।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ যখন বুঝতে পেরেছেন উত্তম কুমার নামক অভিনেতাকে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে অনেক দিন লাভের অংক করানো যাবে তখন থেকেই তারা নানাভাবে উত্তমবাবুকে ব্যবহার করেছেন।

যাইহোক ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপ মোচন’ এবং ‘সবার উপরে’ এই তিনটি ছবির যদি একটা প্যাকেজ ভাবা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাবো প্রথম ছবির থেকে তৃতীয় ছবিতে উত্তম এবং সুচিত্রা দু’ জনেই অনেক পরিণতমানের অভিনয় চেতনার পরিচয় দিয়েছেন; যাকে কেন্দ্র করে ১৯৫৬ সালের মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো অনেকটা সোনার ফসল ফলাতে পেরেছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

সাল তারিখের নিরিখে ১৯৫৫ সালের ১৩ নভেম্বর পাবলিক স্টেজে ‘শ্যামলী’ নাটক অভিনয়ের শেষ রজনী ঘোষিত হয়। উত্তম কুমারের দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য বলতে পারব না এরপর উনি আর জনসমক্ষে পেশাদারী মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ পাননি।

খ্যাতি না খ্যাতির বিড়ম্বনা সময় তার সাক্ষী। মঞ্চ থেকে রেহাই পাওয়া অতি ব্যস্ত উত্তম নিজেকে বিনিয়োগ করলেন ক্যামেরার সামনে। স্ত্রী গৌরী, ছেলে গৌতম, বাবা-মা-ভাইদের নিয়ে ভরপুর সংসারী উত্তম ঝাঁপিয়ে পড়লেন আগামী দিনের ছবিগুলোর জন্য।
‘সাগরিকা’-র মূল শুটিং যখন শুরু হয় ‘সবার উপরে’ তখন বাজারে আসি আসি করছে। ‘সবার উপরে’ ছবির তৈরির সময় সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য সুর সংযোজনায় কলাকুশলী থেকে নির্মাতারা পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন সুদিন ফিরতে চলেছে।

সেখান থেকেই ‘সাগরিকা’ ছবির চিত্রকল্পের সূত্রপাত। চিত্রনাট্য রচয়িতা নিতাই ভট্টাচার্যের মুন্সিয়ানায় অগ্রগামীর বপন করা বীজ ফুলে-ফলে ভরে উঠেছিল প্রতিটি ফ্রেমে। আর সবচেয়ে বড় চমক ছিল উত্তম এই প্রথম ডাক্তার সাজলেন। ‘শাপমোচন’-র বেলায় দারিদ্রদের সঙ্গে লড়াই করা মহেন্দ্র যখন মাইক্রোফোনের সামনে রেডিওতে গান করছেন দর্শক শ্রোতাদের প্রত্যেকের মনের ভেতরে থাকা নায়কোচিত ভাব, সমস্ত অংশে যেন সমান ভাবে ফুটিয়ে তুলছেন উত্তম কুমার নামক স্বপ্নসন্ধানী।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল

মানুষের মনের ভেতর হিরোইজিমের যে ছায়া লুকিয়ে থাকে উত্তম যেন তারই প্রতিনিধি হিসাবে সেলুলয়েডে নিজেকে প্রকাশ করছেন। আমরা অসুস্থ অবস্থায় ডাক্তারবাবুকেও ঠিক ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে চিন্তা করে একটা সহজ উঁচু আসনে তাঁকে দিয়ে থাকেন।

সেই পোশাকটি যখন কোন নায়ক যিনি আমার খুব পছন্দের তিনি পরিধান করে যখনই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন আমাদের মনের অবচেতন সত্তা বারবার যেন তার সেই অতি মানবোচিত একটা রূপ সমীহ আদায় করে নিচ্ছেন। সেই লোকটার জীবনে যখন প্রেম প্রীতি ভালোবাসার টানাপোড়েন শুরু হয় তখন আমরা দর্শক-শ্রোতারা, কোথায় যেন তাঁর সাথে সমমনস্ক হয়ে পড়ি।
এই সূক্ষ্ম সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট উত্তম কুমারকে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল। আর পরিচালক গোষ্ঠীও সেই বোধটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে সম্পর্কের কালো দিকটা নিয়ে ‘সবার উপরে’ ছবিতে যেভাবে একজন আইনজীবীকে দেবতার আসন দান করেছিল এখানেও তেমনি একজন ডাক্তারের মানসিক সততা সমাজকে কোন পর্যায়ে শিক্ষা দিতে পারে‌ তার একটা মানদণ্ড ছবির নির্মাতারা দর্শকদের সামনে রাখতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

উত্তম কুমার তো ভালো অভিনয় করবেনই কিন্তু পাশাপাশি সুচিত্রাকে কোন পর্যায়ে রাখলে ছবিতে দুজনের মানসিক দোটা না দর্শকের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে, এই অংশটা পরিচালক গোষ্ঠীকে জন্ম দিতে হয়েছে। সেখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সময় উপযোগী সাংগীতিক বিন্যাস।

ডাক্তার হিসাবে সুন্দর একটা মননের পরিচয় উত্তম রাখতে পেরেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে যখন ‘সপ্তপদী’, ‘সূর্যশিখা’, ‘অগ্নীশ্বর’ জাতীয় ছবি নির্মিত হচ্ছে তখন কোথায় যেন আমরা মনের অবচেতনে বলে ফেলেছি আমাকে যে ডাক্তার দেখেন তিনি যদি এরকম হতেন বা এইরকম একজন ডাক্তারের কাছে আমি কবে আমার অসুবিধা নিয়ে যেতে পারবো? যা, একজন পরিচালক এবং ক্ষণজন্মা অভিনেতার প্রাপ্য।
“সাগরিকা” ছবিতে শ্যামল মিত্রের কন্ঠ ব্যবহার সম্পূর্ণটাই সঙ্গীত পরিচালকের মুন্সিয়ানা। আর আগামী দিনের মহানায়ক খুব সুন্দর ভাবে সেটার রূপায়ণও করেছেন। সহ অভিনেতাদের যোগ্য সঙ্গত, ছবিটিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। তারা যেন চোখ দিয়ে বলছিলেন ‘সুচিত্রা-উত্তম’! তোমরা এগিয়ে চলো আমরা তোমাদের দু’ জনের পাশে আছি।

আর সিনিয়র অভিভাবকদের যোগ্য সম্মানের যে দৃষ্টি সেটাও যেন প্রতিটি অংশে নায়ক নায়িকার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল। ‘সাগরিকা’ ছবির ইউএসপি ছিল এটাই।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content