বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

এ বছর জানুয়ারি মাসে স্পেনের অ্যারাগন উপত্যকায় দ্বার খুলেছে কানফ্র্যাঙ্ক। এটি সেই সত্তরের দশক থেকে বন্ধ অবস্থায় পড়েছিল। একটানা সংস্কারের পর একেবারে নতুন চেহারায় ধরা দিয়েছে সে। এখন ফ্র্যাঙ্কে একঝলক দেখতে বহু পর্যটক ভিড় জমাচ্ছেন।

এই কানফ্র্যাঙ্ক কেন এত বিখ্যাত? এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান করতে উথে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। টন টন সোনা পাচার, গুপ্তচরবৃত্তি, গ্রেফতারি থেকে শুরু করে নাৎসিদের কোপ এড়াতে বহু ইহুদিদের দেশত্যাগ— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের বহু ঘটনারই সাক্ষী এই কানফ্র্যাঙ্ক আন্তর্জতিক রেলওয়ে স্টেশন।
যদিও এখন আর সেই রেল স্টেশনের কোনও অস্তিত্ব নেই। প্রায় ৪৩ বছর ধরে সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পরে এখন এক বিলাসী হোটেলের রূপ নিয়েছে। ইতিহাস বলছে, কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯২৮ সালে। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন স্পেনের সম্রাট সপ্তম ফার্দিনান্দ এবং ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট গ্যাস্তোঁ দুম্যাগ। ভৌগলিক দিক দিয়েও সেই স্টেশনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এর একদিকে যেমন স্পেনের এলাকাভুক্ত, তেমনি আবার ফ্রান্সের সীমান্তঘেঁষা। সে কারণে সেই অনুষ্ঠানে দু’ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:

মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

এ প্রসঙ্গে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মোরালেস। তিনি বলেন, ‘‘কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের পুনরুজ্জীবনে আমরা খুব খুশি।’’ কানফ্র্যাঙ্ক সেই সত্তরের দশকে প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর সৌন্দর্যে তখনও চোখ ফেরানো যেত না। চিত্রগ্রাহকদের বারবার ওখানে টেনে নিয়ে আসত। স্পেনীয় স্থাপত্যবিদ ফার্নান্দো রামিরেজ দি দমপিয়ের তাঁর সমস্ত শিল্পসত্তা দিয়ে কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের নকশা করেছিলেন।

কারও কারও মতে, কানফ্র্যাঙ্কের পরিত্যক্ত ধ্বংসপ্রায় ভূতুড়ে চেহারা নিয়েছিল। যদিও তাঁদের কাছে সেই ভূতুড়ে চেহারাই বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো। তবে এখনকার সেই অভিজাত কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনকে চেনাই দায়। এখানে এখন ৪টি স্যুইট-সহ ১০০টি ঘর নিয়ে তৈরি হয়েছে আস্ত বিলাসী হোটেল। সুইমিং পুল, ওয়েলনেস এরিয়া এবং ৩টি রেস্তরাঁ আরও অনেক কিছু দিয়ে সাজানো হয়েছে সেই হোটেল। যদিও কানফ্র্যাঙ্কের সুইমিং পুলে নামতে গেলে অতিরিক্ত ১৫ পাউন্ড করে দিতে হবে। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় দেড় হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কানফ্র্যাঙ্কের চেহারায় এই মসৃণতা ছিল না। তবে হতাশা এবং আশার আলো, দুয়েরই সাক্ষী এই কানফ্র্যাঙ্ক।

ছবি: সংগৃহীত।

‘সিএনএন’-কে র‍্যামন হাভিয়ের ক্যাম্পো ফ্রেইল নামে এক সাংবাদিক বেশ কিছু অজানা তথ্য জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৯৪০ থেকে ’৪২ অবধি বহু ইহুদি প্রাণ বাঁচাতে এই স্টেশন দিয়েই দেশ ছেড়েছেন। চলে গিয়েছেন লিসবন এবং আমেরিকায়।

র্যা মন জানান, জার্মানির একনায়ক হিটলারের ভয়ে ভিটেমাটিছাড়াদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন মার্ক্স আর্নস্ট, মার্ক শাগালের মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ছিলেন ফরাসি বংশোদ্ভূত আমেরিকার গায়িকা-অভিনেত্রী জোসেফিন বেকারও। বলা যেতে পারে সব ইতিহাসেরই সাক্ষী এই কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

২০১৭ সালে সংবাদমাধ্যমে মোরালেস জানান, মিত্রশক্তির হয়ে নাৎসি বিরোধী ফরাসিদের দলে অসংখ্য গুপ্তচর যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা সে সময় এই স্টেশনকেই ব্যবহার করেছিলেন। মোরালেসের কথায়, গুপ্তচরদের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে মিত্রশক্তির নেতৃত্বও কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের মাধ্যমে নানা তথ্য পাঠিয়ে দিতেন ফ্রান্স এবং স্পেনে। যদিও পরে সেই কানফ্র্যাঙ্ক পুরসভা ১৯৪২ সালেই নাৎসিদের দখলে চলে যায়। ১৯৪৪-এর জুন পর্যন্ত তাদের দখলেও ছিল। ১৯৪২-১৯৪৪ এই সময়ে পর্যন্ত কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন দিয়ে পালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এই স্টেশনে বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। সে অর্থে বহু গ্রেফতারের সাক্ষী এই কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল

স্বাদে-আহ্লাদে: আম কাসুন্দি প্রিয়? বানানোর সময় এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখবেন

বস্তুত, কানফ্র্যাঙ্কই ছিল একমাত্র স্পেনের পুরসভা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখল করে নাৎসিরা। সে সময় বহু মানুষ পর্তুগালের লিসবনে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর জন্য প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেফতার করে নাৎসিরা। এ সময় গ্রেফতারের পরে শয়ে শয়ে মানুষকে স্পেন একাধিক জেলে বন্দি রাখা হয়েছিল।

এই রহস্য রোমাঞ্চের কানফ্র্যাঙ্ককে ঘিরে টান টন সোনা পাচারেরও গল্প রয়েছে। মোরালেসের কথায়, সে সময় জার্মানরা কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনকে ব্যবহার করে প্রচুর সোনা এবং দামি ধাতুর পাচার নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা ফ্রান্সের পতাকাও নিচু করে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে র্যা মনের বক্তব্য, এই স্টেশন দিয়ে নাৎসিদের সোনা পাচারের জল্পনাও সে সময় ক্রমশই বেড়েছিল। প্রশাসনও ২০০০ সালে সেই নাৎসিদের সেই সোনা পাচারের জল্পনাকে সত্যি বলে সিলমোহর দেয়। র‍্যামন জানান, এখান দিয়ে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল অবধি সোনা পাচারের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নাৎসিরা প্রায় ৮৬ টন সোনা পাচার করেছিলেন বলে জানা যায়। স্থানীয় এক বাসচালক হাতেনাতে সেই প্রমাণ পেয়েছিলেন।

ছবি: সংগৃহীত।

র্যা মনে কথায়, ‘সোনা পাচারের প্রমাণ ইউরোপীয় এবং আমেরিকার একাধিক আর্কাইভ থেকেও পাওয়া গিয়েছে। সেই সব তথ্য ঘেঁটে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন দিয়ে ১০০ টনের বেশি সোনা পাচার করা হয়। তবে সে সব অন্ধকার দিন আজ অতীত।

স্পেনের বার্সেলো হোটেল গ্রুপ কানফ্র্যাঙ্ককে নতুন ভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে। কারণ দশকের পর দশক এটি বন্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। একে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেখানকার প্রশাসনও জড়িয়ে আছে। কানফ্র্যাঙ্ককে নতুন রূপ দেখে স্থানীয়রা মুগ্ধ। এমনটা জানিয়েছেন কানফ্র্যাঙ্কের মেয়র ফার্নান্দো স্যাঞ্চেজ মোরালেস। তাঁর কথায়, শুধু পর্যটকরাই নন, কানফ্র্যাঙ্কের টানে স্পেনে পা রাখছেন বহু ইতিহাসের প্রেমীও।

উত্তর আয়ারল্যন্ডের বেলফাস্টের বাসিন্দা স্থাপত্যবিদ টমাস ও’হেয়ার। তিনি কানফ্র্যাঙ্কের সংস্কারকাজের সময় এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। হোটেল হিসেবে যাত্রা শুরু করার পরে টমাস আবারও সেখানে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, কানফ্র্যাঙ্কের বহিরঙ্গ এককথায় অসাধারণ। এখানে পৌঁছলে এমন মনে হবে যে, যেন অন্য কোনও যুগে পৌঁছে গিয়েছি।’’
* অজানার সন্ধানে (Unknown story): ড. সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content