বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


তাড়কাবধের পর নিষ্কণ্টক বনে বিশ্বামিত্র এবং রাম ও লক্ষণ নিশ্চিন্তে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। প্রভাতবেলায় মহর্ষি বিশ্বামিত্র, পরম সন্তুষ্টচিত্তে রামচন্দ্রকে দিব্যাস্ত্র প্রদান করলেন। ঊনষোড়শবর্ষীয় কৈশোরোত্তীর্ণ বালকের সামর্থ্য এবং আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে তোলাই হয়তো তাঁর অভিপ্রায় ছিল। নিরুপদ্রব শুন-শান বন, রাক্ষসদের তাণ্ডবমুক্ত। বনবাসীরা এখন পরম নিশ্চিন্ত। স্বস্তি, সুখনিদ্রা মানুষকে শান্ত করে, প্রীত করে, দয়ার্দ্র্যচিত্ত দানে উদার হতে চায়। পরিতৃপ্ত বিশ্বামিত্র রামকে বললেন—

পরিতুষ্টোঽস্মি ভদ্রং তে রাজপুত্র মহাযশঃ

হে মহাকীর্তিমান রাজতনয়, পরিতৃপ্ত হৃদয়ে আমি পরমানন্দে তোমায় অস্ত্র দান করতে চাই।

দেবাসুরগণান্ বাপি সগন্ধর্ব্বোরগান্ ভুবি। যৈরমিত্রান্ প্রসহ্যাজৌ বশীকৃত্য জয়িষ্যসি।। তানি দিব্যানি ভদ্রং তে দদাম্যস্ত্রাণি সর্ব্বশঃ।
দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, নাগগণ যাঁরাই শত্রুতা করবে তাঁদেরকেই বশীভূত করে যুদ্ধে পরাজিত করবে এমন সব দিব্য অস্ত্র আমি তোমায় দিচ্ছি। দিব্য অস্ত্র মনে হয়, প্রাকৃতিক শক্তির মতোই অব্যর্থ। অপ্রতিহত তাদের শক্তি। কত যে তাদের নামের বাহার, সেই অস্ত্রের যোগ্য আধার এবং অধিকারী বিরল। রামচন্দ্র অস্ত্রদের বললেন—

মনসা মে ভবিষ্যধ্বম্

তোমরা আমার মনে মিশে থেক। রামচন্দ্র অমিত শক্তির অধিকারী হলেন বটে ,অস্ত্র সংবরণ মন্ত্রও যে তাঁর প্রয়োজন। অব্যর্থ, অমোঘ এইসব অস্ত্রের তীব্র অভিঘাত। শুধু প্রয়োগকৌশল নয় প্রয়োজনে এগুলির সংবরণ কৌশল জানবার প্রয়োজন আছে‌। দক্ষ যোদ্ধা হতে চান ভাবি রাজা রামচন্দ্র। তিনি অস্ত্র গুলির সংবরণের বিষয়টিও জানতে চান।

অস্ত্রাণাং ত্বহমিচ্ছামি সংহারান্ মুনিপুঙ্গব।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁকে সংবরণজ্ঞান প্রদান করলেন।সেইসঙ্গে রামচন্দ্রকে যোগ্য পাত্র মনে করে অন্যান্য নানা অস্ত্রও দান করলেন।কৃতজ্ঞচিত্তে,মধুর কন্ঠে, রামচন্দ্র অস্ত্রগুলির উদ্দেশ্যে বললেন, মানসাঃ কার্য্যকালেষু সাহায্যং মে করিষ্যথ মনেতেই রইলে তোমরা যথাকালে আমাকে সাহায্য করো। দূরে নিবিড় অরণ্য যেন মেঘ পরিবৃত। বহু বিহঙ্গের কলকাকলিতে মুখর ওই জায়গাটি অতি সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন। ওটি কার আশ্রম?

কস্য আশ্রমপদং ত্বিদম্?

ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের প্রতি জিজ্ঞাসু রামচন্দ্র। আপনার সেই স্থান কোথায়? যেখানে আপনি নির্বিঘ্নে যাগক্রিয়ায় উদ্যোগী হয়েছেন? যেখানে যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসদের প্রতিহত করে আপনার যজ্ঞক্রিয়া রক্ষা করবো আমি?

ভগবংস্তস্য কো দেশঃ সা যত্র তব যাজ্ঞিকী। রক্ষিতব্যা ক্রিয়া ব্রহ্মন্ ময়া বধ্যাশ্চ রাক্ষসাঃ।।

মহর্ষি বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে জানালেন বামনরূপী বিষ্ণু এখানে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। স্থানটি সিদ্ধাশ্রম নামে প্রসিদ্ধ। এই সেই স্থান যেখানে অসুররাজ বলি দেবতাদের বিজয়ের লক্ষ্যে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ব্রতী হয়েছিলেন। বিষ্ণু বামনরূপ ধারণ করে বলিরাজার কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রার্থী হিসেবে। তিনি ত্রিপদ পরিমিত ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন। বামনের প্রার্থনা পূরণ করলেন অসুর রাজ বলি। ত্রিপদবিক্ষেপে ত্রিলোক অধিগত করলেন বামনরূপী বিষ্ণু। সমস্ত মানসিক ক্লান্তি দূর হয়েছিল এখানে, এই আশ্রম তাই শ্রমনাশন।বামনের প্রতি শ্রদ্ধায় স্থানমাহাত্ম্যে বিশিষ্ট এই আশ্রমই এখন আমার আশ্রয়, অবহিত করলেন ঋষি। ময়াপি ভক্ত্যা তস্যৈব বামনস্যোপভুজ্যতে। রামচন্দ্রকে আন্তরিক সমাদরে বললেন—

তদাশ্রমপদং তাত তবাপ্যেতদ্ যথা মম এই আশ্রমটি যেমন আমার তেমন তোমারও।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং কয়েকটি প্রশ্ন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৭: প্রতিশোধের আগুন কি ডেকে আনল মৃত্যুমিছিল?

রামচন্দ্রের অনুরোধে ঋষি বিশ্বামিত্র যজ্ঞে দীক্ষিত হলেন। সিদ্ধাশ্রম নাম সফল হোক অর্থাৎ বিষ্ণুর ঐতিহ্য অনুসারে রামচন্দ্র যেন অচিরেই ঋষির অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারেন। সত্য হোক ঋষির বচন, এই কথায় ঋষি বিশ্বামিত্রকে আশ্বস্ত করলেন রামচন্দ্র। সিদ্ধাশ্রমোঽয়ং সিদ্ধঃ স্যাৎ সত্যমস্তু বচস্তব।। মন্ত্রোচ্চারণে যজ্ঞ বেদীতে অগ্নিসংযোগ করলেন ঋত্বিকগণ। পবিত্র বেদমন্ত্র উচ্চারণে মন্দ্রিত হল যজ্ঞভূমি। ষষ্ঠদিনে হঠাৎ গগনে যেন ঘনঘটা। মারীচ ও সুবাহু দুই রাক্ষস মায়া বিস্তার করল। রাক্ষসদের অনুচররা বেদীর অভিমুখে রক্তবর্ষণ করতে লাগল। মানবাস্ত্রে মারীচকে শতযোজন দূরবর্তী সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন রামচন্দ্র। প্রাণে বধ করলেন না তাকে। হয়তো মাতৃহারা মারীচের প্রতি অনুকম্পা বোধ করলেন তিনি। সুবাহুকে আগ্নেয়াস্ত্রপ্রয়োগে ধরাশায়ী করলেন। বায়ব্য অস্ত্রে ঘায়েল করলেন অনুচর রাক্ষসদের। নির্বিঘ্নে যজ্ঞ সম্পন্ন হল। ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র আশীর্বাদ করে বললেন, কৃতার্থোঽস্মি মহাবাহো কৃতং গুরুবচস্ত্বয়া। সিদ্ধাশ্রমমিদং সত্যং কৃতং বীর মহাযশ।। হে মহাবাহু রাঘব, আমি আজ কৃতার্থ। তুমি গুরুর আদেশ পালন করেছ, সিদ্ধাশ্রম নাম আজ সার্থক। মুনিবরের প্রশংসায় ধন্য হলেন রামচন্দ্র।

রাত্রি অতিবাহিত হলে রামচন্দ্র ঋষি বিশ্বামিত্রকে আনত বিনয়ে বললেন,হে মুনিশ্রেষ্ঠ এই দুই সেবক উপস্থিত। আদেশ করুন কি আজ্ঞা পালন করব এখন।

ইমৌ স্ম মুনিশার্দ্দূল কিঙ্করৌ সমুপাগতৌ। আখ্যাপয় মুনিশ্রেষ্ঠ শাসনং করবাব কিম্।।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৬: গভীর সমুদ্র, আন্টার্কটিকার হিমশৈল থেকে মরুভূমি হয়ে পর্বতের হ্রদ—মাছেদের উপস্থিতি সর্বত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

বিশ্বামিত্রকে সামনে রেখে আশ্রমিক মুনিবৃন্দ বললেন, মিথিলার রাজা জনকের দেবদত্ত আশ্চর্য ধনুকের বৃত্তান্ত। সুনাভ নামে ধনুকটিতে জ্যা বা গুণ আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছেন দেব, গন্ধর্ব, অসুর, রাক্ষস এবং মানুষ। এখন রাজা জনকের প্রদর্শনযোগ্য একটি দ্রষ্টব্যমাত্র সেই ধনুক।পরম সমাদারে পূজিত হয় দেবতুল্য সেই ধনুক। বিশ্বামিত্র মিথিলাধিপতির আয়োজিত যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে সেই আশ্চর্য ধনুক রামচন্দ্রকে দেখাতে চান। তার মনে হয়তো ছিল রামচন্দ্রের পেশীশক্তির পরীক্ষার সময় হয়তো সমাগত। গন্তব্য মিথিলা। পথটির অভিমুখ উত্তরে জাহ্নবীনদীতীর। সূর্য যখন অস্তাচলে মুনিবর বিশ্বামিত্র রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে উপস্থিত হলেন শোননদীর তীরে।

যথারীতি পরম বিস্ময়ে রামচন্দ্র বিশ্বামিত্রের কাছে অরণ্যসমৃদ্ধ সেই স্থানটি সম্বন্ধে জানতে উৎসুক হলেন। ধার্মিক মুনিশ্রেষ্ঠ গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র শোননদীর গতিপথ বর্ণনাপ্রসঙ্গে নিজবংশের উৎপত্তির বৃত্তান্তও বর্ণনা করলেন। ব্রহ্মতনয় কুশের চার পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ বসু তিনি গিরিব্রজ নগরের প্রতিষ্ঠাতা, যার অপর নাম বসুর নামানুসারে বসুমতী। এই বসুমতী এবং পাঁচটি প্রধান পর্বত ও শোননদী বসুরাজার অধিগত। শোননদী পাঁচটি পর্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যেন রমণীর কণ্ঠহারের মতো। মগধদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে শোননদীর অন্য নাম মাগধী। উর্বরতার কারণে মাগধীনদীর দুদিক শস্যসম্পদে পরিপূর্ণ। রাজা কুশের অপর এক পুত্র কুশনাভ। তাঁর ঔরসে জন্ম নিয়েছিল একশত কন্যা। নৃত্যগীতরতা, রূপযৌবনবতী সেই শতকন্যাদের পছন্দ হল বায়ুর। প্রস্তাব দিলেন, বায়ুকে বিবাহ করলে আর মানুষভাব থাকবেনা তাঁদের। অক্ষয় যৌবন লাভ করবেন কন্যারা। অমরত্বের আকর্ষণে সাড়া দিলেন না কুশনাভকন্যারা।

রাজকন্যারা এ প্রলোভন উপহাসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, তাঁরা সত্যপরায়ণ পিতার কন্যা। পিতার ওপর তাঁদের অসীম আস্থা।রাজা কুশনাভ কন্যাদের যাঁর হাতে সম্প্রদান করবেন তিনিই হবেন তাঁদের স্বামী। বায়ু সর্বত্রগামী। সকলের মনের খবর তাঁর নিশ্চয়ই জানা আছে। অন্তশ্চরসি ভূতানাং সর্বেষাং সুরতসত্তম। প্রভাবজ্ঞাশ্চ তে সর্ব্বাঃ কিমর্থমবমন্যসে।।

কন্যারা বললেন বায়ুকে, হে সুরশ্রেষ্ঠ,সকলের মনের গভীরে বসে আছেন আপনি, স্বভাবের প্রভাব অজ্ঞাত নয় আপনার। তবে কেন এই অবমাননা?বায়ু ক্রোধে আত্মহারা হয়ে কন্যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে দিলেন। বায়ুর অবৈধ পথ অবলম্বনের ফলে লাঞ্ছিতা হলেন কুশনাভকন্যারা। বায়ু যে স্বেচ্ছাচারিতায় সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়। প্রাকৃতিক শক্তি বায়ু, অদম্য। বায়ুতে তাই দেবতাদের শক্তির আরোপ। তাঁর প্রতিহিংসার অন্তরালে লুকিয়ে আছে সংহাররূপের উগ্রতা। বায়ু যে অন্তঃস্থলে বসে আছেন, প্রাণবায়ুকে যে ক্ষমা করতেই হবে। ক্ষমাশীল কুশনাভ, কন্যাদের ক্ষমাগুণের প্রশংসা করলেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১২: হঠাৎ স্নানঘর থেকে পঞ্চমের চিৎকার ‘মিল গয়া মিল গয়া’, সৃষ্টি হল সেই জনপ্রিয় গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৮: সানন্দা বলেছিল, ‘বসুন্ধরা ভিলায় ফিরে এলে আমি হেরে যাবো দাদু’

ক্ষমাশীল কুশনাভ ক্ষমার যে সংজ্ঞা দিলেন তা যেন বিশ্বামিত্রের বয়ানে রামের প্রতি ক্ষমার অসীম শক্তির মূল্যায়ন। কুশনাভের মতে, ক্ষমাই দান। ক্ষমাই সত্য। ক্ষমাই যজ্ঞ, ক্ষমা যশ, ক্ষমাই ধর্ম, সমগ্র পৃথিবী ক্ষমা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ক্ষমা দানং ক্ষমা সত্যং ক্ষমা যজ্ঞশ্চ পুত্রিকাঃ।। ক্ষমা যশঃ ক্ষমা ধর্ম্মঃ ক্ষমায়াং নিষ্ঠিতং জগৎ। ক্ষমাগুণ সর্বযুগের সর্বকালের প্রাসঙ্গিক। তাই এই প্রশংসা তাৎপর্যপূর্ণ।

ঋষি বিশ্বামিত্রের কুশনাভকন্যাদের বৃত্তান্ত উপস্থাপনায়—সহনশীলতা, নমনীয়তার শিক্ষা। যথাসময়ে রাজা কুশনাভের শতকন্যা পিতার ইচ্ছা অনুসারে চুলী নামে এক মহর্ষি এবং গন্ধর্বী সোমদার পুত্র ব্রহ্মদত্তের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। ব্রহ্মদত্তের স্পর্শে কন্যারা পূর্বশ্রী ফিরে পেলেন। শতকন্যাতেও মন ভরলনা রাজা কুশনাভের। অপুত্রক রাজা এবার পুত্র কামনায় পুত্রেষ্টি যাগ সম্পন্ন করলেন। পিতা কুশের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তাঁর পুত্রের নাম হল গাধি। তিনিই বিশ্বামিত্রের পিতা। কুশ রাজার পৌত্র তাই মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আরকটি নাম কৌশিক। বিশ্বামিত্রের এক জ্যেষ্ঠা ভগিনীও জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর নাম সত্যবতী। সত্যবতী স্বর্গারোহণের পর তাঁর নামানুসারে কৌশিকী নদী আজও প্রবাহিত। ভগিনীস্নেহবশত সত্যবতীর স্মৃতিধন্য কৌশিকী নদীতীরে ঋষি বিশ্বামিত্রের বর্তমান নিবাস। সেই ভগিনী যেন পবিত্র নদীরূপে বিরাজমান।

অরণ্য, পাহাড়, ভূমি, নদীর মতোই সত্য যে চিরন্তন। তাই নদীর মতোই যুগে যুগে তার পথপরিক্রমা, বিশ্বামিত্রের সিদ্ধাশ্রমে গমনের কারণ হল যজ্ঞানুষ্ঠানে সিদ্ধিলাভ। সেই কাজে তিনি সফল। স্থানমাহাত্ম্য বর্ণনাপ্রসঙ্গে নিজের বংশবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন ঋষি। ইতিমধ্যে রাত্রি দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হল। নিস্তব্ধ রাত্রিতে তরুরা নিস্পন্দ, নিকষ কালো আঁধারে অনন্ত আকাশের বুকে ফুটে উঠেছে অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ। উদীয়মান চাঁদ স্নিগ্ধ শীতল, কিরণচ্ছটায় সকলের মন মাতিয়ে প্রকাশমান। রাতের আঁধারে অশুভ শক্তির রহস্যময় পদচারণা। রাতের শোভা দেখতে দেখতে নীরব হলেন ঋষি। অস্তগামী সূর্যের মতোই নিদ্রাভিভূত বিশ্বামিত্র, সেই সঙ্গে দুই ভাই রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণও।
জীবন বহতা নদীর মতো। নদী, বিশ্বামিত্রের উপলব্ধিতে যেন মমতাময়ী ভগিনী, যার স্নেহচ্ছায়ায় অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করতে চান ঋষি। আমাদের নদীমাতৃক দেশে মমতাময়ী মাতৃসমা জ্যেষ্ঠা যেন নদী, যার পবিত্রতায়, উর্বরতায়, পরশে, আত্মীয়তার ছোঁয়া। এই অনুষঙ্গের অবতারণায় দেশের স্রোতস্বিনীদের প্রতি কী যত্নশীল হওয়ার ইঙ্গিত? পথপ্রদর্শক উপদেশদাতার মহান বংশপরম্পরায় নিহিত আছে ত্যাগ, সত্যপরায়নতা, ক্ষমা― যত মানবিক গুণ। বংশগৌরবে কৌশিক গাধেয় বিশ্বামিত্র, এক মহান আদর্শবান বংশের উত্তরসূরী। সিদ্ধাশ্রমের পুরা ইতিহাস সাফল্যের।এই সিদ্ধির ইতিহাস যে পরবর্তী দূরবর্তী প্রজন্মকে জারিত করে উৎসাহে প্রাণিত করবে,এ যেন সেই অনুপ্রেরণার কাহিনি। যেমন গৌরবময় অতীতের আলোচনা সমৃদ্ধ করে পরবর্তী প্রজন্মকে অনেকটা সেই রকম।

একজন ষোড়শবর্ষীয় কিশোরকে পিতার স্নেহচ্ছায়াচ্যুত করে এনেছেন ঋষি বিশ্বামিত্র। দায়বদ্ধতা কিন্তু বিস্মৃত হননি। তাকে অস্ত্রসম্ভারে স্বাবলম্বী করে তুলে তার আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন, শিখিয়েছেন অস্ত্রের প্রয়োগ বিদ্যা এবং সংবরণ কৌশল। ঋষি বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয় রাজোচিত জীবনের অতীত স্মৃতি একজন যুবরাজকে কিভাবে ভাবিজীবনে আদর্শ রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে গুনগরিমায়,সেই দিকেই যেন প্রশিক্ষণের লক্ষ্য শিক্ষাগুরু বিশ্বামিত্রের। নিয়মানুবর্তিতায়, শৃঙ্খলারক্ষায়, দায়বদ্ধতা পালনে, দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বর্ণনা শ্রবণে আন্তরিকতার ছোঁয়ায়, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে ভালোবাসার আত্মিক সম্পর্ক আবিষ্কারে রোমাঞ্চিত বিস্ময়াবিষ্ট কিশোর রামচন্দ্রের এই নরম, পেলব, কোমল, রূপ যেন এক নতুন আবিষ্কার। একজন দায়িত্ববান স্বামী হতে হলে নিজের পেশীশক্তি এবং পরম্পরাগত বংশপরিচিতি ছাড়াও চারিত্রিক গুণের বিকাশের প্রয়োজন আছে। হরধনুর প্রসঙ্গ অবতারণায়—নিজের অজান্তেই কোন দায়িত্বভার বহনে,যোগ্যতাপ্রমাণের পথে পা বাড়ালেন যেন রামচন্দ্র। ঋষির বিশ্বামিত্রের সাহচর্যে, এ যেন তারই শুভসূচনা।

রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দিতে নিসর্গশোভা,রামচন্দ্রের কাছে ছিল অধরা।প্রকৃতি তাকে প্রাণময় বাঙ্ময় করে তুলেছে। তাই হয়তো বনবাসজীবনও সীতাহরণের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কাছে ক্লেদাক্ত মনে হয়নি। কারণ সেখানে ছিল অনাবিল প্রকৃতিসুন্দরীর সান্নিধ্য। বনবাসজীবনে, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বিরহী রামচন্দ্রের শান্ত, গম্ভীর বর্ষার রূপবর্ণনা এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এই সবকিছুই এই সদ্য যৌবনে উপনীত এক তরুণের স্মৃতির সমৃদ্ধ সম্পদ বলেই মনে হয়।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content