সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ : ০১/১২/১৯৫৫

প্রেক্ষাগৃহ : রূপবাণী,অরুণা ও ভারতী

পরিচালনা : অগ্রদূত

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম : শঙ্কর

আবার উত্তম-সুচিত্রা! মানুষের মনে ধিক ধিক করে জ্বলা আগুনটা আবার গনগনিয়ে উঠলো। ‘শাপমোচন’-র পর যতগুলো ছবিতে উত্তম কুমার অন্যান্য নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছেন সেগুলো পরিচালকের গুণে হোক বা দোষে হোক, পর্দায় সাফল্যের রূপরেখা ছিল অ্যাভারেজ। কিন্তু সুচিত্রা-উত্তম স্ক্রিনে আবার অগ্রদূতের তত্ত্বাবধানে হাজির হওয়াতেই মানুষের মনে নতুন করে আসা দানা বাঁধতে শুরু করল।

এ যেন লক্ষ্মণ এবং দ্রাবিড়ের ঐতিহাসিক ইডেন টেস্ট ম্যাচের পুনরাবৃত্তির ঘটনাকে মনে করিয়ে দেওয়া। ভাবখানা এমন যে, ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বুকে টেস্ট খেলতে গিয়ে ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড় যখন যৌথভাবে ভারতীয় দলের ব্যাটিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে ব্রেট লি’দের বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল মানুষের মনে হয়েছিল আবার সেই ঐতিহাসিক ইডেন টেস্ট শুরু হল।

আমি এরকম উপমা দিলাম একটাই কারণে যে, এ প্রজন্মের আমজনতা উত্তম-সুচিত্রার কি বিপুল পরিমাণে ক্রেজ ছিল তা’র অনুমান করতে সহজ হবে বলে।
মানুষের মনে একটা সহজাত ধারণা প্রস্তুত হয়েছিল যে, এঁরা দুজন পর্দায় মুখোমুখি হওয়া মানেই নতুন কিছু চমক অপেক্ষা করছে। দর্শকদের এ ধরনের প্রত্যাশাকে অনুভব করতে ছবি নির্মাতাদেরও খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি। বিশেষত, চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব যেখানে নিতাই ভট্টাচার্য-র মতো মানুষের হাতে।

আগেই বলেছি, দেশভাগ এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মানুষের ভেতরে আর্থসামাজিক যে পালাবদল ঘটে গিয়েছিল তার একটা রিলিফ ছিল উত্তম সুচিত্রার মুখোমুখি রসায়ন। ওঁরা দু’ জনই মানুষকে স্বপ্ন বিলাসী করে তোলার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখতেন না।

মনে রাখতে হবে, বাজারে কিন্তু তখন শুধু উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন এদের ছবিই চলেনি। পাশাপাশি গোটা পাঁচের দশকে সাহেবি কালচারে অভ্যস্ত এলিট ক্লাস বাঙালি কিন্তু বেশি করে হলিউড মুভি দেখতেন। কখনো কখনো কালে ভদ্রৈ বোম্বের হিন্দি ফিল্মে মন দিতেন। কিন্তু বাংলা ছবিতে একেবারেই বুঁদ হয়ে থাকা এলিট ক্লাস বাঙালির কিন্তু সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬: টাকা-পয়সা খরচ করে পরিদর্শনের লোক রাখলেও, নিজে পর্যবেক্ষণ না করলে সবকিছুই বিনষ্ট হয়

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৫: আর্য কোথায়?

উত্তম-সুচিত্রাকে এই শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছিল। তাদের নিজস্ব ঘরানা তৈরি হবার পরও সমগ্র বঙ্গ সমাজে কুলীন দর্শকরা তাদের ছবিকে খুব একটা মর্যাদা দিতেন না।

বাংলা ছবির সালতামামি যাঁরা ঠিকঠাক আলোচনা করেন তাঁরা একটা কথা মানতে অবশ্যই বাধ্য হবেন যে, পঞ্চাশের দশকে উত্তম কুমারের মতো কালজয়ী শিল্পীর আবির্ভাব, সত্যজিৎ-ঋত্বিক মৃণাল সেনদের মতো পরিচালকদের আবির্ভাব, বম্বে ফেরত হেমন্ত কুমার বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সংগীত পরিচালক, তথা বিশ্বমানের সংগীতের রসদ মজুদ থাকা সলিল চৌধুরীর মত এলিট ক্লাসের সুধী সমাজ বাংলাদেশের একটা রুচিশীল দর্শকের জন্ম দিতে পেরেছিল যার স্থায়িত্ব পরবর্তী সত্তরের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত হয়েছিল।

আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, উত্তম সুচিত্রার বিষয়টা ‘এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’ গোছের ছিল না। আজ আমরা অনেকেই সত্যজিৎ রায়, অজয় কর, ঋতুপর্ণ ঘোষ বা সৃজিত মুখার্জি বা অন্যান্য পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্র বিশারদদের ছবি আতস কাঁচের তলায় রেখে অনেকেই উত্তম সুচিত্রার রসায়নকে বাঁকা চোখে দেখি কিন্তু তাঁদের ছবি যখন বাজারে এসেছিল তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘নায়ক’-র মতো সিনেমা ‘পদাতিক’-র মতো সিনেমা বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র মতো সিনেমা তৈরিই হয়নি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৬: গভীর সমুদ্র, আন্টার্কটিকার হিমশৈল থেকে মরুভূমি হয়ে পর্বতের হ্রদ—মাছেদের উপস্থিতি সর্বত্র

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

এই জায়গাতেই সকলে ভুল করে বসেন উত্তম কুমারের প্রথম দশ বছরের চলচ্চিত্র, শেষ দশ বছরের চলচ্চিত্র সবকিছু আলোচনা করে একটা খিচুড়ি পাকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যা বেশ কয়েক দশক ধরে যত্ন সহকারে চলছে। পাশাপাশি একটা প্যারামিটার অদৃশ্যভাবে খাড়া করা হয় যে, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে উত্তমবাবু কতবার সুযোগ পেয়েছেন।

প্রশ্ন হল সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটক এঁরা যদি নাও আসতেন ফিল্মের জগতে যদি অন্য পেশা অবলম্বন করতেন তাহলে কি উত্তম কুমার, উত্তম কুমার হতে পারতেন না? নিশ্চয়ই পারতেন।

ওঁদের কালজয়ী ছবিগুলো ছাড়া উত্তম কুমারের অস্তিত্ব কিন্তু আছে। পাশাপাশি সুচিত্রা সেন, কোনদিন সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-ঋত্বিক ঘটকের সাথে ছবি করতে সুযোগ পাননি বা করেননি। তাহলেও আমজনতার মনে তিনি মহানায়িকার আসন পেয়েছেন।
‘সবার উপরে’ সিনেমার সবচেয়ে বড় সম্পদ কাহিনির বুনন। কাহিনির সুন্দর কেন্দ্রবিন্দু দিয়ে গোটা সিনেমাটাকে পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া এবং নায়ক নায়িকার মানসিক গঠনকে সুচারুভাবে প্রকাশ করার একটা চরম চেষ্টা ছিল এ ছবির পরতে পরতে। মোদ্দা কথা হল, ছবিটির মেকিং এমন সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছিল যে, একজন মানুষ সিনেমা দেখার আগে এবং সিনেমা দেখার পরে নিজেকে নিজেই খুঁজে বেড়াবেন।

উত্তম সুচিত্রা ছাড়াও আরও যে সমস্ত সহ অভিনেতা অভিনেত্রী ছিলেন তাদেরও চেষ্টাও কোনও অংশে ত্রুটি ছিল না। ছবি বিশ্বাসের মুখে ‘ফিরিয়ে দাও আমার বারোটি বছর’ ডায়লগটি, অনেক অংশে ফিল্ম্মোচিত হয়নি। কিন্তু পরিচালক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন দৃশ্যটির ছবিকে নিয়ন্ত্রণে বা নির্মাণে।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৩: ‘অপরাজিত’র সম্পাদনার সময় সত্যজিতের মনে হয়েছিল মিলি চরিত্রটির প্রয়োজন নেই, অগত্যা বাদ পড়লেন তন্দ্রা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১২: হঠাৎ স্নানঘর থেকে পঞ্চমের চিৎকার ‘মিল গয়া মিল গয়া’, সৃষ্টি হল সেই জনপ্রিয় গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’

অন্যদিকে শোভা সেন, পাহাড়ি সান্যাল তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র এ ধরনের সহশিল্পীদের বলিষ্ঠ অভিনয় ছবিটির অন্যতম সম্পদ ছিল। নীতিশ মুখোপাধ্যায় কালীসাধক এবং নায়ক হিসাবে দর্শকসমাজে সমীহ আদায় করে নিতেন। হঠাৎ করে তার ভিলেনের রোলে অভিনয়, অনেকটা পরবর্তীকালে উত্তম কুমারের ‘বাঘ বন্দী খেলা’ সিনেমার ছক যেন প্রস্তুত করে দিয়েছিল।

এ ছবির আরও একটি সম্পদ রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুটি অমর হয়ে যাওয়া গান। যে প্রেক্ষিত নিয়ে ছবির দৃশ্যায়ণ, দুটি গানের তার সঙ্গে কোনও মিল ছিল না। হঠাৎ ছবিটির কাহিনি মাথায় রেখে ওই দুটি গান শুনলে গান দুটির সারস্বত মর্যাদা হানি হবে।

কেউ যদি শুধু গান শুনবো বলে গান দুটি শোনেন তাহলে কালজয়ী গানের তালিকায় উক্ত গানগুলি থাকবে। আসলে মানুষ আত্মিকভাবে যখন তলিয়ে যায়, আশার সমস্ত আলো যখন নিভে যায় সে মুহূর্তে যদি কোন সহৃদয় প্রিয়জন, তাঁর অন্তরের মমতা-প্রীতি দিয়ে পাশের লোকটিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তখন সে চেষ্টাটা হয়ে যায় ঐশ্বরিক।
গানদুটির জন্ম, সেই মানুষের ভেতরে জমে থাকা ঐশ্বরিক চেতনার রূপক হিসাবে। সে দিক দিয়ে গান দুটির লিটারারি মর্যাদা অনেক বেশি। যেখানে মানুষ মাথা ঘামায়নি, ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কেমন, ছবিটি কি হলিউডের মতো কোনও সিনোপসিস কে অপেক্ষা করছে ইত্যাদি।

এ বছরই যখন ক্যামেরাকে কথা বলিয়ে প্রকৃতির বুক থেকে একের পর এক দৃশ্যকল্পের রূপায়ণ সেলুলয়েড দেখাবেন সে ছবি (পথের পাঁচালী) মুক্তি পাবে।

তার আগে আলপিন টু এলিফ্যান্ট সমস্ত শ্রেণীর দর্শক, অগ্রদূতের পরিচালনায় ‘সবার উপরে’ ছবিকে সত্যের পরম কল্যাণময় সোপানে পৌঁছে দিয়েছেন। ফল হাতেনাতে। ছবি কুড়ি বারেরও বেশি পুনর্মুক্তি। সুপার-ডুপার হিট।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content