সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


সুইমিং ট্রেনারকে দেখতে পেয়ে ধড়ে যেন প্রাণ এলো। ভয়ে বুক শুকিয়ে যাওয়া ঠিক কী মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম। স্বাভাবিক হবার আপ্রাণ চেষ্টায় অকারণ কথা শুরু করলাম।

—ছুটি হয়ে গেল?

—হুঁ

—সোজা বাড়ি তো?

—হুঁ

ভালো সাঁতার দিতে গেলেও কি কথা কম বলতে হয়! হুঁ ছাড়া কোনও উত্তরই দেয় না। ধাপগুলো পেরিয়ে ঠিক সেখানটা পৌঁছেছি যেখানে একটু আগেই…

—বাড়ি কখন পৌঁছবে?

অসভ্যের মতো হর্ন দিতে দিতে ঠিক তখনই একটা বাস গেল। বেপাড়ার কুকুরের মতো সে তার সগোত্রের একটি বাসকে তাড়া করেছে। রাত বাড়লে প্যাসেঞ্জার কমে যায় তখন প্রাইভেট বাসের এসব বেপরোয়া বাড়াবাড়ি শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে কমবয়সি ট্রেনার শুনতে পায়নি। ভুরু আর নাক একসঙ্গে কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—

কী?

ঠিক সেই জায়গাটাতে গায়ে যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া লাগলো। ফ্রিজের দরজা খুললে বা এয়ারকন্ডিশনড সিনেমা হলে ঢোকার সময় যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক তেমন। আমি স্বাভাবিক থাকতে একটু গলা তুলেই বললাম।

—বলছি বাড়ি। কখন পৌঁছোবে?

—রাত হবে। ফেরার বাস যেমন পাব।

সত্যিই তো। সকলের তো আর শহরে থাকার মত সুবিধা নেই। রোজগারের জন্য শহরে আসতে হয়। লিখি বলেই নানান লোকজনের সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নেওয়াটা স্বভাব। আমি জানি পুলিন বলে এই সুইমিং ট্রেনার সকালে একটা পাবলিকেশন হাউসে কাজ করে। আগে বইয়ের ব্যবসার খুব রমরমা ছিল। কিছু মানুষ নিয়মিত বই কিনে পড়তেন উপহার দিতেন। কালিকাগজ বাঁধাই এর খরচা বেড়ে যাওয়া এবং বই বিক্রি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের বই পড়ার ইচ্ছে পাল্লা দিয়ে কমেছে। এককালের জমজমাট বইয়ের প্রকাশক এখন টিমটিম করে দোকানটুকু টিকিয়ে রেখেছেন। বইয়ের বিশ্বায়ন ঘটেছে। ছাপানো বই, ডিজিটাল ই-বুক হয়ে গিয়েছে। বাংলা বইয়ের থেকে এখন ভারতীয় লেখকের ইংরেজি পেপারব্যাক পড়াটা অনেক কেতার। উঠতি গায়ক-গায়িকার নিজের খরচায় অ্যালবাম বের করার মতোই, লেখকেরা আজকাল নিজ খরচায় বই ছাপেন আর বইয়ের প্রকাশক বই বিক্রি করেন। পুলিন যেখানে কাজ করে সেই প্রকাশনা সংস্থা এখন অন্য প্রকাশকের বই নিজেরাই ছেপে অনলাইনে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেন। এক জায়গায় অনেকের কাজ একসঙ্গে হয়। কর্মচারীদের সারা মাসের স্থায়ী রোজগার। সারাদিন পুলিনকে সেখানে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। তাই সন্ধ্যের পরে এই ট্রেনিং এর কাজটায় এসে বেচারা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু ক্লাবেরও সুবিধে। যে টাকাটা তারা দেয় তাতে একজন টগবগে ছুটে বেড়ানো সুইমিং ট্রেনার পাবে কোত্থেকে।
ঈশ্বরের কৃপায় আমাকে পয়সা দিয়ে বই ছাপাতে হয় না, উল্টে আমি মোটামুটি একটা টাকা আমার বই থেকে রোজগার করি। আমার দুই দিদি। আমি ছোট। দিদিদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মাকে নিয়ে আমি একাই থাকি। দিদি জামাইবাবুরা আমার বিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই যে বললাম নিজেকে আয়নায় দেখে এতটুকু পছন্দ না হলেও আমার পছন্দের মাপকাঠি সেই কালিদাস। ফলতঃ লবডঙ্কা! আমি কোন রাজা দুষ্মন্ত যে, আমার জন্য স্বয়ং শকুন্তলা বনেজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে? এইসব ভাবতে ভাবতেই যুবক বয়সটা হাত থেকে বেরিয়ে গেল। দিদি জামাইবাবুরা হাল ছেড়ে দিল। আমিও বিয়ে করার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। বিয়েওয়ালা অনেক বন্ধু-বান্ধবদের দেখেছি অনেক পরাধীনতার মধ্যে মানিয়ে গুনিয়ে চলেছে। হ্যাঁ সেরকম কাউকে দেখতে পেলে না হয় একটু কমপ্রোমাইজ করা যেত। দেখতে তো পেলাম না। স্টুডিওতে ডাইনে বামে আলো ফেলে কম্পিউটারের কারিগরিতে চকচকে ঝকঝকে করা ছবি দেখে প্রাথমিক বাছাই পাত্রীদের মুখোমুখি দেখার পরেই হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম। কিশোর থেকে যৌবনের চৌকাঠে পুজোর সময় এটা খুব হতো। এক মন্ডপের দেবীদর্শন সেরে অন্যমন্ডপে যাবার পথে আনাচে-কানাচে দূর থেকে আসা যে মানবপ্রতিমাদের মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের আলো আঁধারিতে অসাধারণ রূপসী লেগেছিল মুখোমুখি স্পষ্ট দর্শন হতেই মুহূর্তে স্বপ্নভঙ্গের কষাঘাতে যেন সন্ন্যাস গ্রহণের বৈরাগ্য।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২: কপালে জমেছে ঘাম, শুকিয়ে গিয়েছে জিভ, পেছন থেকে ভেসে আসছে গা ছমছমে শব্দ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

ইংলিশ টিংলিশ: LOL, ASAP, ATM, etc বা e. g.-এর পুরো কথাগুলো কী জানেন?

এর একটা যন্ত্রণার অতীত আছে। একটা গভীর গোপন ক্ষত। আসানসোলে আমার ছোটপিসির বাড়ি। বড় পিসি থাকত বিহারের মজঃফরপুরে। ছোট পিসির বিয়ে হয়েছিল আসানসোল। আমার পিসতুতো বোন বুনির ছোটবেলার বান্ধবী আফিফা। বুনির ভালো নাম বনানী। আমি আফিফাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। পড়াশোনায় ভালো। খুব ভালো নাচত। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত। বুনিদের পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বনানী আফিফা একসঙ্গে নাচতো। তখন সময়টা অন্যরকম ছিল তো। তখন আমি ক্লাস টেনে। বুনিরা ক্লাস নাইন। সেবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ওরা শ্যামা করেছিল। আফিফা শ্যামার ভূমিকা অভিনয় করেছিল। সেই প্রথম আমিও উপলব্ধি করলাম আমি এবং আফিফা দুজনেই বড় হয়ে গিয়েছি। আফিফা নামের মানে হল পবিত্রতা। এতো পবিত্র চোখ আমি কারো দেখিনি। মনে হয়েছিল আফিফাকে ছেড়ে আমি আর বাঁচবো না। ছেলেদের থেকে মেয়েদের বোধ বুদ্ধি অভিজ্ঞতা সবই বেশি হয়। বুনির বারণ না মেনেই আমার আর আফিফার প্রেম দিনে দিনে গভীর হতে লাগলো। দেখা হতো না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠির আদান-প্রদানে সে প্রেম তীব্র থেকে তীব্রতর হল। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর বুনি কলেজে ভর্তি হল। আর আফিফার বিয়ে হয়ে গেল দুবাইয়ের এক পাত্রের সঙ্গে। এ যেন মহাভারতে রথের চাকা ভাঙ্গার পর কর্ণের যুদ্ধবিরতির অনুরোধ অস্বীকার করে অর্জুনের “অঞ্জলিক” বাণে অসর্তক কর্ণের মস্তকছেদন মতো। কোন মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই ধরাশায়ী হওয়া। কৈশোরে কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমের প্রভাব, প্রাকযৌবনে আফিফার প্রতি তীব্র প্রেমের সাঙ্ঘাতিক অপমৃত্যু আর যৌবনের আদি থেকে অন্ত কোন প্রকৃত শকুন্তলা বা আফিফাকে খুঁজে না পাওয়া এই ত্রিফলা যোগে আমার ব্যাচেলার দশা চিরস্থায়ী হল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২০: দুর্নীতির দুর্বিপাকে পিতৃতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব

লেখালেখির জগতে পরিচিতি সুবাদে নানা জায়গায় যেতে হয় নানা ধরনের মানুষের সম্মুখীন হতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই বহু পুরুষের মতো বহু নারী গুণগ্রাহীও আছেন। তাঁদের মধ্যে আমার চেয়ে কমবয়সী অনূঢ়া বা সমবয়সী এক দু’ বছর বাড়তি অবিবাহিতা বা বিবাহবিচ্ছিন্নারা উৎসাহ দেখাননি এমনটা নয়। আয়নায় নিজের সঙ্গে উত্তমকুমার বা হৃত্বিক রোশনের কোনও রকম মিল খুঁজে পাইনি তবু নিভৃতে কফিকাপ নিয়ে সময় কাটানোর প্রস্তাব পেয়েছি। আমার পাবলিশারদের অনুরোধে এবং নিজের বইয়ের প্রমোশনের জন্য শহর ও রাজ্যের এমনকি দেশের বাঙালি অধ্যুষিত বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে বছর বছর আমার লেখা নতুন উপন্যাস থেকে পাঠ করার অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানে কোন কোন অতি উৎসাহী আমার হোটেলের ঘরে পর্যন্ত ধাওয়া করেছেন। কিন্তু ওই যে প্রাকযৌবনে একবার পিসতুতো বোন বুনির অভিজ্ঞতার বাধায় আমল না দিয়ে বারণ কানে না তুলে ভয়ংকর ধাক্কা খেয়েছিলাম। সেই ভয়ংকর স্মৃতি আমায় সময়ের কঠিন নিয়ন্ত্রণে আমায় বেঁধে রেখেছে। খাওয়াদাওয়া বিশ্রাম করা। গল্পের বই পড়া সিনেমা দেখা। লেখাজোকা। এতে তো কায়িক পরিশ্রম নেই। ফলে শরীর প্রস্থে বেড়েছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দৈর্ঘ্যে বেড়েছে। মেঘে মেঘে বেলা মানে বয়েস বেড়েছে। তাই এখন আর লাড্ডু খাওয়া না খাওয়ার এক্সপেরিমেন্ট এ গিয়ে কাজ নেই। লাড্ডু খাওয়াই মানা।

ছোট্ট একটা গাড়ি আমার আছে। কিন্তু ডাক্তারের আদেশ মেনে সুইমিংপুলে যাওয়া আসা আমি হেঁটেই করি। মানে এই কদিন যে শুরু করেছি, সেটা হেঁটেই। শরীরও বাঁচছে পেট্রোলও বাঁচছে। একেই বোধহয় বলে উইন-উইন সিচুয়েশন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৪: ভয়ংকর গর্ভ

সুইমিং পুল থেকে আমার বাড়ি সাধারণ গতিতে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো। সুইমিং পুল থেকে রাস্তায় নেমেই আজ বেশ জোর-পায়ে হাঁটছি। এতক্ষণে তো আমার…আশপাশটা অচেনা লাগছে। তার মানে আমি কি আজ বে-খেয়ালে ভুল রাস্তায় চলে এসেছি! মনে হচ্ছে আমি আমাদের ফ্ল্যাটে যাবার আগের গলিটায় ডানদিক নিয়েছি। এই গলি আসলে বাঁক নিয়ে উল্টোদিকে ঘুরেছে। মানে আমি গলিটা দিয়ে যত এগিয়েছি আসলে ততই পিছিয়ে সুইমিং পুলের দিকে গিয়েছি। যদিও এতদিন এখানে থেকেও এই গলিটায় আসার কখনও দরকার হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে সুইমিং পুলের পিছন দিয়ে এই গলিটা। দাঁড়িয়ে ভাবলাম। এই রাত্তিরে বাড়ি ফেরার নতুন রুট আবিস্কার করার কোনও প্রয়োজন নেই। চেনা পথে ফেরাটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এরকম ভুল হল কী করে? তবে কি আমাকে কিছুতে বশ করেছে। আমি এসব খুব একটা বিশ্বাস করি না। তবে এরকম পরিবেশ পরিস্থিতিতে খুব একটা জোরের সঙ্গে অবিশ্বাস করতেও পারছি না। এখন যেন এই রাস্তাটা টপকে ফিরে যেতেও পারছি না।—চলবে

রাস্তার ওপারে যেতে কেন এতো অস্বস্তি লাগছে! ছবি: সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content