বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে।

দ্বারকানাথের পুত্র গিরীন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান গুণেন্দ্রনাথ। গুণেন্দ্রনাথ বড় অকালে, মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। ‘গুণদাদা’-র ‘সৌন্দর্যবোধ ও গুণগ্ৰাহিতা’ রবীন্দ্রনাথকে বালক বয়সেই মুগ্ধ করেছিল। তিনি ছিলেন ‘গুণদাদা’র অত্যন্ত স্নেহভাজন।

গুণেন্দ্রনাথ ভালো ছবি আঁকতেন। আর্ট স্কুলে ছবি আঁকার পাঠ নিয়েছিলেন। গুণেন্দ্রনাথের চার পুত্রের মধ্যে কুমারেন্দ্রনাথ শৈশবেই মারা গিয়েছিল। তাঁর দুই পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ছবি-আঁকার খ্যাতি দেশের সীমা অতিক্রম করে ওদেশেও পৌঁছে গিয়েছিল। পুত্র সমরেন্দ্রনাথও ছবি এঁকেছেন। এমনকি কন্যা সুনয়নী দেবীও ছবি আঁকতেন।
অবনীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন, ছবি লিখেছেন। শুধু শিশুসাহিত্য নিয়ে চর্চা নয়, শিল্পতত্ত্ব নিয়েও লিখেছেন। গগনেন্দ্রনাথ ছোটোদের কথা ভেবে একটি বই লিখলেও ছবি আঁকাতেই ছিলেন নিবেদিত-প্রাণ।

অবনীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াত কন্যা করুণার পুত্র মোহনলাল। গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন তিনি। মোহনলাল বয়সে তখন নিতান্তই বালক। সারাক্ষণই দুই দাদামশারের কাছাকাছি থাকতেন। মোহনলাল লক্ষ করেছিলেন, ‘গগন আকাশকে ভালোবাসতেন। আকাশের রং, আকাশের মেঘ, আকাশের কোল ঘেঁষে বকের পাতি তাঁর মনে যে দাগ কেটে যেত, তা নিয়ে কত ছবিই এঁকেছেন…।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে: আপনার সন্তান কি অমনোযোগী?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪: একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৫: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবপ্রজন্ম-মীনমিত্রের পরামর্শে গ্রামগঞ্জেও মাছচাষ বিকল্প আয়ের দিশা দেখাতে পারে

আকাশ ছিল গগনেন্দ্রনাথের বড় প্রিয়। আকাশ ঘিরে যত মুগ্ধতা, আকাশের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। নীল আকাশের গায়ে ঘুড়ির ওড়াওড়ি দেখতেন। কালীপুজোর রাতে ঠায় বারান্দায় বসে থাকতেন। রঙিন ফানুস দেখতেন। হাউই দেখতেন। সেই হাউই থেকে রঙিন তারা যেন ঝরে ঝরে পড়ত। গগনেন্দ্রনাথ মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়েই থাকতেন। দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে পাহাড় থেকে আকাশ দেখে যেমন আনন্দ পেতেন, তেমনই আনন্দ পেতেন জোড়াসাঁকোর বারান্দা থেকে আকাশ দেখে। নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যেত একটুকরো আকাশ। সেদিকে প্রায়শই তাকিয়ে থাকতেন। নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা টুকরো আকাশের ছবিও এঁকেছেন।

সমরেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ।

জোড়াসাঁকো-বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছিল মদনমোহন চ্যাটার্জি লেন। সেখানে নলিনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। পরে তাঁর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্কও হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের কন্যা উমার বিবাহ হয়েছিল এই পরিবারে। নলিনীচন্দ্র ছিলেন শ্বশুরমশায়। তাঁর পুত্র নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল অবনীন্দ্র-কন্যার।

নলিনচন্দ্রের ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর শখ। মস্ত বড় ঘুড়ি। গগনেন্দ্রনাথ শুধু নন, উড়তে থাকা তাঁর মস্ত ঘুড়ি অবাক-চোখে দেখতেন সবাই। বাড়িতে কারিগর ডেকে তিনি যত্ন করে তৈরি করতেন এই ঘুড়ি। শক্ত সুতোয় মস্ত ঘুড়ি গোঁ গোঁ শব্দ তুলে উড়ত। উড়ত জোড়াসাঁকো-বাগানের নারকেল গাছ আর বকুল গাছের মাথার ওপর দিয়ে। অন্য কোনও ঘুড়ি কাছে ঘেঁষতে সাহস দেখাত না।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৬: ব্যর্থ প্রেমের বহ্নিশিখা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০: প্রশিক্ষক গুরু বিশ্বামিত্র, নারীহত্যা না মানবধর্ম?

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: কাঁচা মিঠে আমের এই সব গুণাগুণ জানতেন?

কখনও সকালের দিকে, কখনও-বা বিকেলের দিকে ছাদে বা বাগানে বসে গগনেন্দ্রনাথ দেখতেন নলিনচন্দ্রের ঘুড়ি ওড়ানো। নলিনচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হলেই তাঁর ঘুড়ি ওড়ানোর প্রশংসা করতেন, উৎসাহ দিতেন। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে দেখতে গগনেন্দ্রনাথের মধ্যেও ঘুড়ি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে জাগে।

গগনেন্দ্রনাথ।

ঠাকুরবাড়ির মানুষজন কষ্ট সইতে পারতেন না। আরামে থাকতেন। বিলাসী জীবনযাপনেও কেউ কেউ অভ্যস্ত ছিলেন। ঠান্ডা উপভোগ করতে দার্জিলিং-এ যেতেন। সমুদ্রের হাওয়া খেতে নিয়ম করে যেতেন পুরীতে। পুরীতে ‘পাথারপুরী’ নামে একটি নিজেদের বাড়িও ছিল। গরম পড়লে জোড়াসাঁকো ছেড়ে কেউ কেউ ফাঁকা জায়গায় গিয়ে থাকতেন। নির্জনে গাছপালার মাঝে প্রাণ জুড়োত। প্রায়শই গরমকালে থাকতেন ময়দানের কাছে। ফাঁকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে দু-তিন মাস দিব্যি কাটিয়ে আসতেন। আজকের ময়দান বা চৌরঙ্গীর সঙ্গে মেলালে চলবে না। তখন উত্তর কলকাতাই ছিল জমজমাট। দক্ষিণে লোকজন কম। ফাঁকা-ফাঁকা, গাছ-গাছালিতে ভরা। সেবারও চৌরঙ্গীতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। ফাঁকা ময়দানে আপন মনে ঘুরতেন। আকাশ দেখতেন। বাতাস উপভোগ করতেন। একদিন পায়ে পায়ে হাজির হয়েছিলেন আর্মি অ্যান্ড নেভি স্টোর্সে। চৌরঙ্গীর এই দোকানে নানা রকমের বিলিতি জিনিস পাওয়া যেত। প্রায়ই আসতেন গগনেন্দ্রনাথ। ফলে ম্যানেজারের সঙ্গেও তাঁর হৃদ্যতা হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে চিকেন কারি আর ভালো লাগছে না? বাড়িতেই রেস্তোরাঁর মতো বানিয়ে ফেলুন মুর্গ মালাই হান্ডি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

দোকানে বিলিতি জিনিসের আশ্চর্য সমাহার। গগনেন্দ্রনাথ এটা-সেটা নেড়েচেড়ে দেখতেন। কখনও বা কিনতেন। একদিন গিয়ে দেখলেন, সদ্য এসেছে একজোড়া ‘বাক্স ঘুড়ি’। বাক্স ঘুড়ি দেখে তাঁর বিস্ময়ের শেষ রইল না। চোখে মুখে কৌতূহল। এ ঘুড়ি কী করে ওড়ায়, কেমন করে ওড়ায়, নানা প্রশ্ন মনে খেলে গেল। গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় যে স্মৃতিমিশ্রিত বইটি লিখেছিলেন, সে বইটিতে আছে, ‘সেদিন গিয়ে দেখলেন একটা নতুন জিনিস এসেছে দোকানে— একজোড়া বাক্স ঘুড়ি। নতুন জিনিস দেখে গগনের লোভ হল, তখনই কিনে নিলেন। ম্যানেজার সায়েব বুঝিয়ে দিলেন যে এ ঘুড়ি একটা একটা করে আলাদাও ওড়ানো যায়। আবার দুটোকে একসঙ্গে বেঁধে ওড়ানো যায়। গগন তো ঘুড়ি দুটি বগলে করে বাড়ি ফিরে এলেন। তোড়জোড় করতে লাগলেন, তার পরদিন যাতে ঘুড়ি দুটো ওড়ানো যায়।’

গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা।

পরের দিন সত্যিই সে ঘুড়ি ওড়ানো হল। ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে এলাহি আয়োজন। বিকেলে বাড়ির সবাইকে ছাদে নিয়ে গেলেন গগনেন্দ্রনাথ। বাড়ির কাজের লোকজনও বাদ পড়ল না। সবাই হইহই করে উঠে এল ছাদে। কেমন করে এই ‘বাক্সঘুড়ি’ ওড়ে, তা দেখার জন্য তাদের তখন অধীর আগ্রহ।

খুব গরম ছিল সেদিন। গুমোট আবহাওয়া। একটু পরেই অবশ্য হাওয়া উঠল। ঝড়ো হাওয়া। হাওয়া উঠতেই গগনেন্দ্রনাথ ঘুড়ি দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে সবাই আনন্দে হইহই করতে শুরু করলেন। গগনেন্দ্রনাথের তো আর আনন্দ ধরে না। হঠাৎই ওঠে ঝড়ো হাওয়া। হওয়ার জোর ক্রমেই বাড়তে থাকে। হাওয়া যত বাড়ে, ঘুড়ির গর্জন তত বাড়ে। হাওয়ার দাপটে শেষে বাক্স ঘুড়ির সুতো পটাং করে ছিঁড়ে গেল। মুহূর্তেই কোথায় ছিটকে গেল সেই ঘুড়ি। না, আর দেখা গেল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

খানিক আগেও সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছিল। হঠাৎই যেন অন্ধকার নেমে আসে। সে অন্ধকার গগনেন্দ্রনাথের মুখে সব থেকে বেশি ঘনীভূত হয়েছিল।

অবনীন্দ্রনাথের লেখাতেও আছে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রসঙ্গ। তিনি এক ঘুড়িপ্রিয় মানুষের কথা শুনিয়েছিলেন।। তাঁর নাম কানাই মল্লিক। যিনি ঘুড়িতে পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোট গেঁথে দিতেন। এই ‘শখে’ তিনি নাকি শেষে ‘শক’ পেয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, শখ মেটাতে গিয়ে যথাসর্বস্ব খুইয়েছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন, ঘুড়ি ওড়ানোর এক আশ্চর্য আখ্যান। চরম বিপর্যয়, রাজ্য হাতছাড়া হচ্ছে, ইংরেজ কৌশলে তা করায়ত্ত করছে, সে সব নিয়ে রাজামশায়ের ভাবনা-দুর্ভাবনা নেই।

রবীন্দ্রনাথের বিমানযাত্রা, গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন।

‘ঘরোয়া’তে মহর্ষিদেবের মুখের কথা অবনীন্দ্রনাথ তুলে দিয়েছেন। ‘কর্তাদাদামশায়’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি তখন ডালহৌসি পাহাড়ে যাচ্ছি, তখনকার দিনে তো রেলপথ ছিল না, নৌকো করেই যেতে হত, দিল্লি ফোর্টের নিচে দিয়ে বোট চলেছে— দেখি কেল্লার বুরুজের উপর দাঁড়িয়ে দিল্লির শেষ বাদশা ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। রাজ্য চলে যাচ্ছে, তখনও মনের আনন্দে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন।’ দেবেন্দ্রনাথ যে রাজাবাদশার কথা শুনিয়েছিলেন, তাঁর মতো গগনেন্দ্রনাথের ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা না থাকলেও ঘুড়ির প্রতি তীব্র দুর্বলতা ছিল। আকাশ ভালোবাসতেন, সেই আকাশে ঘুড়ির ওড়াওড়ি, অবাধ বিচরণ তাঁকে মুগ্ধ করে রাখত।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content