রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ২১/১০/১৯৫

প্রেক্ষাগৃহ: রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

পরিচালনা: মৃণাল সেন

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: হীরেন

ভাবা যায় মৃণাল সেন-র মতো বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালক ক্যারিয়ার শুরু করছেন উত্তম-সাবিত্রী জুটির একটি ছবিকে দিয়ে! যে মৃণাল সেন-র নাম আগামী দিনে ঋত্বিক-সত্যজিৎ প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র নির্মাতার সাথে উচ্চারিত হবে। তিনি কিনা তাঁর প্রথম ছবির জন্য মনোনয়ন করলেন সদ্য খ্যাতি পাওয়া, বাণিজ্যিকভাবে হিট দেওয়া ছবির এক নায়ককে।

একই বছরে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাবে আর কিছুদিনের মধ্যে ঋত্বিক ঘটক তখনও তার এলোমেলো চিন্তার রূপায়ণ পূর্ণ করতে পারেননি সে সময় মৃণাল সেন হাত পাকাচ্ছেন ছবির জগতে।
মনে রাখার মতো তথ্য হল সেদিন সত্যজিৎ রায়ও ভাবতে পারেননি যে, উত্তমকুমারকে নিয়ে কোনওদিন তাকে ছবি করতে হবে, ঋত্বিক ঘটক তো কোনওদিনও কোনও ছবিতে উত্তম কুমারকে মনোনয়নই করে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে মৃণাল সেনও এ ‘রাত-ভোর’ ছবি ছাড়া আর কোনওদিন কোন ছবিতে উত্তম কুমারের মনোনয়ন করে উঠতে পারেননি তাহলে কি ছিল সে সময়ের জাদু! এ ছবির আলোচনায় যে অংশটা খুব ভালোভাবে প্রাধান্য পাবে তা হল, উত্তম-সাবিত্রীর যুগলবন্দি।
বাংলা ছবিতে বা ভারতীয় ছবিতে একটা কালিক বিভাজন যা আমরা পরবর্তীকালে করেছি। সেটার স্রষ্ঠা অনেকেই সত্যজিৎ রায়-কে দিয়ে থাকেন কিন্তু আমরা যদি সালতামামি লক্ষ্য করি তাহলে সেখানে ওই সময়ে উদ্ভূত যে বেঙ্গল রেনেসাঁ তার পুরোধা ব্যক্তি হিসাবে শুধু সত্যজিৎ রায় নন সাথে সাথে মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের নামও উচ্চারণ করতে হবে একটা সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা থেকে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

পোন্নিয়িন সেলভান ২: ছোটবেলার ভালোবাসার সামনে ‘পরদারেষু মাতৃবৎ’ও দুর্বল হয়েছিল

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

পরবর্তীকালে আমরা যখন উত্তম কুমারের মূল্যায়ন করি সেখানে সবচেয়ে আগে লক্ষ্য করি নিজস্ব সমস্যার সমাধান না করতে পারার খেসারত হিসাবে অভিনেতা উত্তমকুমার, তারকা উত্তম কুমারের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছেন।

মৃণাল সেন ঠিক এই জায়গাতেই ভুলটা করেছিলেন তিনি তারকা উত্তম ও অভিনেতা উত্তমের পার্থক্যটা খুব বেশি করে প্রথম ছবিতে দাগ দিয়েছিলেন। আমরা ‘নায়ক’ ছবির যে সারস্বত সম্পদকে নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন তুলে থাকি সে মানের পরিণত-মনস্কতা পেতে সত্যজিৎ রায়কেও ক্যামেরা হাতে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ব্যাপারখানা এমন নয় যে উত্তম কুমার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন আর ‘নায়ক’ নির্মিত হল কিন্তু আমরা সঙ্গে সঙ্গে আশা রাখি মৃণাল সেন ক্যামেরার পিছনে দাঁড়ালেন আর উত্তম কুমার ক্যামেরার সামনে চূড়ান্ত সফল হলেন।
ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাতও এখান থেকে। ছবিটিতে মৃণাল সেন যে দায়বদ্ধতা রেখেছিলেন সেটাও ফেলে দেওয়ার মত নয় কারণ সুর সংযোজনার জন্য তারুণ্যের জয়গান গাওয়া সলিল চৌধুরীকে তিনি মনোনয়ন করেছিলেন। কাহিনি নিয়েছিলেন যৌবনের দূত স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে। গীতিকার রূপে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে। গানে কণ্ঠ দেওয়ার দায়িত্ব সেসময়ের হিট সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপরে। ক্যামেরার পিছনে রামানন্দ সেনগুপ্ত। সম্পাদনায় রমেশ জোশী। তাহলে একটা ছবির নির্মাণ পর্বে যতগুলো ভালো ভালো বিভাগ এবং সেই বিভাগে ভালো নির্মাতাদের যদি একটা প্যাকেজ থাকে তাহলে সিনেমাটা গড়পড়তা ভালোর দিকে এগিয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪: একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

এখানে হল না কেন? আমাদের দুর্ভাগ্য মৃণাল সেন স্বয়ং এই সুপার ফ্লপ ছবিকে নিয়ে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে লজ্জাবোধ করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে এ ছবিটির নির্মাতা হিসাবে নিজেকে ভারাক্রান্ত করতেন না। তাহলে সে সময় এক ঝাঁক উত্তম থেরাপির সঙ্গে সঙ্গে এই ছবিটি মুক্তি কেন পেল, কীভাবে পেল এবং এর ব্যর্থতার দায় কেন পরিচালক, শুধু উত্তমকুমারের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে সরে গেলেন ?

এ ধরনের অনেক প্রশ্নের ধারাবাহিক উপস্থিতিতে ‘রাত-ভোর’ ছবিটির একটি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসতে পারে। প্রথমত, উত্তম কুমার কেরিয়ারের প্রথম দিন থেকে নায়ক, তারকা না অভিনেতা এই তিনটি সত্তার যে পারস্পরিক আড়চোখে তাকাতাকি, তার জবাব তিনি নিজেই নির্মাণ করেছিলেন। সময় মানুষের কাছে এমন ভাবে ধরা দেয় যখন নিজের পারস্পরিক সত্ত্বাগুলো গলা জড়াজড়ি করে নিজেকেই অতিক্রম করে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

একথা অনস্বীকার্য যে, অন্যান্য অনেকের মতো উত্তম কুমারের শুরুর দিকের অভিনয় পারম্পর্য আর শেষের দিকের অভিনয় পারম্পর্য এক নয়।
সে সময় বঙ্গদেশে উত্তম ছাড়াও আরও অনেক নায়ক চরিত্র রূপায়ণের মানুষ ছিলেন। কিন্তু উত্তমকুমার একজনই ছিলেন। পরিচালকের প্রথম তিন চারটি মনোনয়নের নায়ক জুতসই না হওয়াতে অবশেষে উত্তম কুমার জায়গা পেয়েছিলেন।

তিনি আশা করেছিলেন যে মানের অভিনয় তিনি প্রতিটি ফ্রেমে প্রত্যাশা করছেন তার প্রত্যেকটি উত্তম বাবু করে ফেলবেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন ঘটনাও ঘটেছে নায়ক বা নায়িকা চরিত্রে মূলত কেন্দ্রীয় চরিত্রাভিনেতা বা অভিনেত্রী ঠিকমত না হলে চেঞ্জ করা গেছে।

কিন্তু প্রথম ছবির বেলায় মৃণাল সেন আপন মেধার ভিত্তিতে সে ঘটনা ঘটাননি। ছবিটি সম্পূর্ণ করেছেন এবং রূপবানী-অরুণা-ভারতী তিনটি হলের চেনে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। পরবর্তীকালে যখন মৃণাল সেন মৃণাল সেন হয়েছেন এবং একটি অন্য ধারার ছবি পরিচালনা করে এলিট ক্লাশে জায়গা পেয়েছেন তখন মনে হয়েছে উত্তম সাবিত্রীকে মনোনয়ন করে প্রথম ছবিটিতে অনেক ভুল ছিল।
আমার মনে হয় সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর যা অকপটে বলার সাহস রেখেছিলেন মৃণাল সেন সে পথ মাড়াননি। তিনি প্রথম থেকেই নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি একজন বাণিজ্যিক ছবি তথাকথিত নায়কের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা নিরাপদ মনে করেছেন। তাই সে সুযোগের ব্যবহার করতে পিছপা হননি।
আমাদের মনন, সব সময় সাফল্যের পিছনে বিনা প্রশ্নে আনুগত্য এনে দেয় আর ব্যর্থতার সামনে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়। মৃণাল সেন যদি কেরিয়ারের দশম ছবিতে উত্তম কুমারকে নিতেন, তাহলে এর ফল উল্টে যেত।

ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্ত র অনবদ্য চিত্রগ্রহণে সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর অনবদ্য সুর সংযোজনায় ছবিটির সারশ্বত মর্যাদা সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা নিরিখে উত্তম কুমারের জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা বলে মনে হয় যা, সে সময়ের কোনো স্তরেই কদর পায়নি। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content