সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ২৯/০৭/১৯৫৫

 

প্রেক্ষাগৃহ: দর্পণা, ছায়া ও পূর্ণ

 

পরিচালনা: অর্ধেন্দু সেন

 

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: বাণীব্রত

আগেই বলেছি ‘শাপমোচন’-র পরবর্তী উত্তম কুমারের যাত্রাপথ, অনেক ভাবে বৈচিত্র্যে পূর্ণ হয়েছিল। কারণ, এক ঝাঁক পরিচালক ছবি তৈরি করে বসেছিলেন রিলিজের জন্য।

কিন্তু মাঝখান থেকে ‘শাপমোচন’ রিলিজ করার ফলে সমস্ত হিসেবের ছক ওলটপালট হয়ে যায়। এর মধ্যে ‘বিধিলিপি’ ছবিটির আগমন, অনেকটা ‘শাপমোচন’-উত্তর উত্তমের উত্তরণকে এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার এক মাসের মধ্যেই পরিচালক অর্ধেন্দু সেন-এর ‘হ্রদ’ ছবি, পুরনো সব হিসাবকে মায় ‘শাপমোচন’-র চলার পথকেও অনেক অংশে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল।

যে উত্তম কুমারকে পরিচালকের দরজায় দরজায়, প্রযোজকের কাছে গিয়ে দরবার করতে হয়েছে দিনের পর দিন। আজ এমন একটা দিন এসেছে যেখানে সেই একই নায়কের পরস্পর দুটি বা তার অধিক ছবি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়।

যে হলের চেনে ‘শাপমোচন’ রমরমিয়ে চলছে তার পাশাপাশি হলের চেনে ‘বিধিলিপি’ রম রমিয়ে চলছে। উক্ত দু’ ধরনের রিলিজের চেনকে উপেক্ষা করে আবার একটি নতুন হলের রিলিজিং চেইন তৈরি করে বাকি সব ছবি রিলিজ করতে হয়েছিল।

আমাদের ভাবতে অবাক লাগলেও স্বীকার করে নেওয়া ভালো উত্তম কুমার নামক তারকার আগমনে শুধু প্রযোজক গোষ্ঠীই অর্থ ঘরে তোলেননি বা শুধু পরিচালকমন্ডলী নিজেদের শিল্পের উৎকর্ষতা প্রদর্শন করেননি। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা শিল্পের আর্থিক বুনিয়াদ অন্যভাবে নির্মাণ হচ্ছিল।
পরিচালক প্রযোজকদের হাত থেকে সম্পূর্ণ হওয়া ফিল্মটিকে দর্শকের কাছে প্রদর্শনযোগ্য করে তুলতেন ডিস্ট্রিবিউটার এবং হল মালিকরা। বাণিজ্যের গতি যেখানে ঊর্ধ্বমুখী সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিত্তবান মানুষেরা নতুন করে হল তৈরি করে সিনেমা ব্যবসায় নেমেছিলেন।

তার হাত ধরে গ্রামগঞ্জে শহরতলির বিভিন্ন অপরিচিত অংশে এই গোটা পঞ্চাশের দশকে সারি সারি প্রচুর নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হয়েছিল। অনেকটা টেলি কমিউনিকেশন ব্যবস্থার উন্নতিতে যেমন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এসটিডি বুথ তৈরি হয়েছিল (যা আজ বিলুপ্ত) এবং কম্পিউটার ব্যবস্থার আগমনে যেমন পাড়ায় পাড়ায় সাইবার কাফে তৈরি হয়েছে সে রকমই স্বাধীনতার পরবর্তী আর্থিক সচ্ছল মানুষেরা নতুন একটি ব্যবসায়িক পথ খুঁজে পেয়েছিলেন সিনেমা হল ব্যবসার মাধ্যমে।

কালের গতিতে আজকে সেই মানের সিনেমা হলে চলছে না বলেই আবার এ ব্যবসার সলিল সমাধি ঘটতে আজকের দিনে খুব বেশি দুর্লভ নয়। আজকের দিনে কলকাতার অনেক নামী প্রেক্ষাগৃহ সময়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতে সেগুলো ভেঙে বহুতল নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে।

যাইহোক মূল প্রসঙ্গ হল, এই যে উত্তমকুমার নামক একজন অভিনেতাকে কেন্দ্র করে টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটি নতুন আবহাওয়া-জলবায়ু দেখা দিয়েছে। এই ১৯৫৫ সালেই উত্তমকুমার নামক একজন অভিনেতাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু পরিচালক ছবি তৈরি শুরু করেছেন যাঁরা পরবর্তীকালে অনেক কৃতবিদ্য পরিচালকে পরিণত হয়েছেন। তাদের হাতে খড়ি হয়েছিল এ বছরই উত্তম কুমারকে কেন্দ্র করে একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

অর্ধেন্দু সেন সেরকমই একজন পরিচালক যিনি এই প্রথম এবং শেষ উত্তমবাবুকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করছেন। এর পরবর্তীকালে উনি প্রায় গোটা সাতেক ছবি তৈরি করেছেন যেখানে উত্তম কুমারকে নিয়ে কাজ করার কোনও সুযোগ ছিল না।

অথচ গুণীজনদের বিচারে ‘হ্রদ’ পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি। ওই বছরই আর কিছুদিন পরে তপন সিংহ, চিত্ত বসু, মৃণাল সেন কমল গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি পরিচালকরা উত্তমবাবুকে নিয়ে ছবি তৈরির হাতে খড়ি দেবেন।

তাঁরা পরবর্তীকালে অনেক নামী চলচ্চিত্রের পরিচালক হলেও উত্তম কুমারকে নিয়ে ছবি তৈরি তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। তার মানে এই নয় যে, এ বছরে তাঁদের তৈরি ছবিগুলো চূড়ান্তভাবে মার খেয়েছিল। আসলে যে সময় দাঁড়িয়ে আজকের মূল্যায়ন আমরা করছি সে সময়ে উত্তমবাবু নিজেকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে নতুন কোনও পরিচালক ছবি তৈরির কথা ভাবলে সবার আগে ওঁর নামই মাথায় আসতো। কারণ উনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার যে যোগ্যতম সেটা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন।

বারে বারে ঘুরেফিরে ‘শাপমোচন’-র কথা চলে আসে। তার কারণ ‘শাপমোচন’ ছবিতে শুধু মাত্র গানই ছবিটির প্রাণ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনি পাশাপাশি উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেনের বলিষ্ঠ অভিনয়ও মানুষের মনে রেখা পাত করেছিল।

অর্থাৎ একটা ছবির দর্শক মহলে জনপ্রিয়তার নিরিখে পরবর্তী কয়েক মাস চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় যে এ ছবির কতটা অংশ সারস্বত মর্যাদায় কালোত্তীর্ণ হয়েছে না হলে সে ছবির কলা কুশলীদের ঠিক পর পর ছবিগুলোতে ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করানোর চেষ্টা চলত না।

‘হ্রদ’ ছবির সামগ্রিক মূল্যায়নের প্রসঙ্গে যে রীতি সে সময়ে অবলম্বন করা হয়েছিল তা ছিল বেশ অভিনব। অর্ধেন্দু সেনের পরিচালনাধীন এ ছবিতে একজন স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা

সত্যি কথা বলতে কি সেই চরিত্রটি যখন পরিচালক উত্তম কুমারকে শুনিয়েছিলেন তখন বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা তাকে ভর করেনি। ছবিটার আগাগোড়া সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট। চরিত্রটিকে বাস্তবায়িত করার কোনও ত্রুটি উত্তম কুমারের মধ্যে ছিল না। তাছাড়া সন্ধ্যারানির আন্তরিক দরদ ভরা অভিনয়ের সহযোগিতায় ছবিটা শেষ পর্যন্ত চমক সৃষ্টি করল।

সমালোচকরা বললেন, উত্তম কুমার স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে প্রথম আবির্ভাব থেকেই দর্শক মনে একটা সম্মোহনী প্রভাব বিস্তার করেন যে ছবি খানিক দূর এগিয়ে যাবার পর ওকে না পেলে দর্শক মন উতলা হয়ে ওঠে। নানা কথা নানা প্রশংসা। কেউ কেউ উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে বলেই ফেললেন উত্তম কুমার নাকি গ্রেগরি পেক এর সমতুল্য অভিনয় করেছেন। আবার অনেকে বললেন, ‘হ্রদ’-এ উত্তম কুমারের শিল্পী জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়।

এ তো গেল সে সময়কার নানা সংবাদপত্র এবং গুণীজনদের প্রশংসায় ভরা উক্তির সালতামামি।

মূল বিষয় হল, সেই সময়ের নিরিখে উত্তমের মানসিক গঠন একজন চিত্র অভিনেতা নিজেকে কুশলী শিল্পী হিসাবে প্রমাণ করার জন্য নানা দিক থেকে চেষ্টা। যার কোনো ত্রুটি তিনি রাখেননি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না সে সময়ে কিন্তু এত সিনেমার সাফল্যের পর উত্তম নিয়মিত স্টার-এ ‘শ্যামলী’ নাটকে নায়ক অনিলের ভূমিকায় অভিনয় করছেন।
স্টুডিও, ইনডোর-আউটডোর ও মঞ্চ এসব কিছুর ভেতর থেকে শিল্পীর নিজেকে প্রকাশ করার যে আন্তরিক আকুতি সেই লড়াইয়ের বাষ্প উত্তমের চোখে মুখে।
একদিন স্টার-এ ‘শ্যামলী’ চলাকালীন উত্তম স্টেজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই বোধ হয় এমনটা হয়েছিল। আসলে কোনও কিছুই সুস্থ স্বাভাবিক মসৃণ পথে তার কাছে ধরা দেয়নি। ফিল্ম লাইনের অনিশ্চয়তা কতখানি সেটা উত্তম কুমার সারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন।

কাজেই পাওয়া জিনিস, কোনওভাবেই যেন হাতছাড়া না হয়ে যায় এই ভয়ে সবসময় কাঁটা হয়ে থাকতেন তিনি। যার ফলে আমরা যারা সমালোচনা করতে করতে অধিকার হারিয়ে লাগামহীন ভাবে তাকে নানা দোষে দুষ্ট করি তাদের মনে রাখতে হবে বা অবশ্যই মনে রাখা দরকার অনেকগুলো জিনিসের মিলিত ফল হল একটা গোটা সিনেমা। যেখানে নিজেকে প্রমাণ করার সঙ্গে সঙ্গে সবার অলক্ষ্যে পরবর্তী ফিল্মে আত্মপ্রকাশের সুযোগটাও করে নিতে হয়। নাহলে তার মূল্য থাকে না।

উত্তম কুমারের সমস্ত ফিল্মি কেরিয়ারেই প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ছাপিয়ে আরও পরবর্তী অংশে নিজেকে প্রকাশ করার একটা তাগিদ দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

পেটের ব্যথাকে একেবারেই অবহেলা করবেন না / পর্ব- ১

স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্র, উত্তমের খুব প্রিয় একটি চরিত্র। কারণ উত্তম যে মননে দীক্ষিত ছিলেন সেখানে ক্যামেরার সামনে বিহেভ করা অর্থাৎ যাকে বাংলায় (বাচিক অভিনয় না করে) আঙ্গিক অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করার একটা ব্যাপার বলা হয়।

‘শাপমোচন’- র উত্তম বাঁধা-ধরা ছকে একটা পরিশীলিত মাপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র উত্তম, সে সময়ের এলটিজম মেন্টেন করে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একমাত্র স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রেই কোনওরূপ পূর্ব প্রস্তুতি দর্শকের চোখে আঁকা থাকে না। তাই তাকে যদি দর্শক-মনোগ্রাহী করে রূপায়ণ করা যায় সেটা অনেকটা মানুষের কাছে চ্যালেঞ্জিং হবে।

আমরা পরপর কটা ছবির যদি প্রেক্ষিত আলোচনা করি সেখানে দেখতে পাবো, ‘হারানো সুর’-র উত্তম প্রথম অর্ধে যখন স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে রূপদান করছেন তখন চোখের ভাষা চলন-বলন বা নিজেকে অন্যভাবে প্রকাশ করার রীতিতে অভ্যস্ত হওয়া সবকটাই আমাদের মন টেনেছে। উত্তম কেরিয়ারের মধ্যগগনে যখন ‘নগর দর্পণে’ ছবিটিতে আত্মপ্রকাশ করছেন তখন চোখের অভিনয় ক্যামেরার সঙ্গে কীভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায় সেটা তিনি প্রকাশ করেছেন যেটা শুরু করেছিলেন এই ‘হ্রদ’ ছবির মাধ্যমে।
আমরা পরিচিত বেশ কিছু ছবির তালিকা যদি আলোচনা করি সেখানে দেখবো, স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে অভিনয় করা থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু আঙ্গিক অভিব্যক্তিকে কোন অংশে নিয়ে যাওয়া যায় তার চরম নিদর্শন ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-র শেষ দৃশ্য বা ‘লাল পাথর’ ছবির শেষ দৃশ্য। শুধু দৃষ্টি দিয়ে দর্শকের মনে আন্দোলন তৈরি করার জন্য সপ্তপদী-র কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির চরিত্র যার তুলনা উনি নিজেই।

অর্থাৎ একটা গোটা ছবিতে অভিনয় করতে করতে সেখান থেকে পাওয়া মণিমুক্তগুলো সাজিয়ে পরবর্তী কোনও ছবিতে লাগিয়ে দেওয়া যায় এ ধরনের একটা হোমওয়ার্ক উনি সব সময় করতেন।

আমরা যদি খুব ভালো করে উত্তমের একেকটা ছবির ‘ফ্রেম টু ফ্রেম’ আলোচনা করি সেখানে দেখবো ‘সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট’ এর জায়গায় ভারতবর্ষের অপ্রতিদ্বন্দ্বি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশে শুধু নয়, তাদের সবার মাথার উপর থাকবেন উত্তম কুমার। প্রত্যেকটা ছবিতে এ ধরনের অংশ খুঁজে পেলেই উনি এমন একটা আঙ্গিক উত্তরণ ঘটাতেন যা সমসাময়িক অনেককেই পিছনে ফেলে দিত।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content